‘আত্মমগ্নতা’র একটি স্থুল ব্যবচ্ছেদ
সঙ্গীতা ইয়াসমিন : একবিংশ শতকে প্রযুক্তি রয়েছে উৎকর্ষতার শিখরে। মানব সভ্যতাকে আরও এগিয়ে নিতে, জীবনযাপনকে সহজতর করার লক্ষ্যে এই প্রযুক্তিগত উন্নয়ন কাঙ্ক্ষিত। বস্তুত এই উন্নয়নফসল ভোগের দৃষ্টান্ত। যদিও এতে কতটা উপভোগ আর কতটা ভোগের(দুর্ভোগ) উপাদান রয়েছে সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই কারোই। অধিকতর উৎকর্ষতার ফসল হিসেবে আমরা যেমন প্রযুক্তির হাতের খেলনা হয়েছি, তেমনি আমাদের জীবনযাপন থেকে হারিয়ে গেছে আদি ও অকৃত্রিম অন্তরের ছোঁয়া। আমাদের হৃদয় নন্দনপুরে আর ফোটে না প্রেমময়, মোহময় গোলাপ।
এই যান্ত্রিক সভ্যতা আমাদেরকে শিখিয়েছে দৌড়, দৌড় আর দৌড়। জিততে হবে, সেরাদের সেরা হতে হবে। হিমালয় জয়, গোল্ডেন এ প্লাস, গাড়ি-বাড়ি, প্রাচুর্য-ঐশ্বর্য সবই চাই জীবনে। এই সব চাই আমাদের সামনে এক অদৃশ্য প্রতিযোগীকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। যার সাথে চলছে প্রতিনিয়ত লড়াই। সেই জন আর কেউ নয়। আমার ভেতরের আমি। আমি যেনো কেবল দম দেওয়া কলের পুতুল।এক যন্ত্রদানবের মত ছুটে চলেছি আমার আমিকে অতিক্রম করতে। অথচ আমি নিজেও ঠিক জানি না কী আমি চাই, কতটুকু হলে আমি সন্তষ্ট! কী আমার আদৌ করা উচিত কিংবা উচিত নয়।এসব জানতে হলে আগে নিজেকে জানা জরুরি। আর নিজেকে জানতে হলে আত্ম মগ্ন হওয়া প্রয়োজন।
স্বভাবতই প্রশ্ন আসবে আত্মমগ্নতা কী? এটি কি আত্মপ্রেম বা নার্সিসজমের মত কিছু? অনেকে হয়তো নার্সিজমের সাথে একে মিলিয়ে ফেলবেন। নার্সিজমে আত্মপ্রেম তো আছেই, নিজের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে অহংকারও আছে। এটি একটি পার্সোনালিটি স্টেট বা টাইপ, এবং সর্বাংশে নেতিবাচক। মনোবিজ্ঞানীরা একে পার্সোনালিটি ডিসর্ডার বলে অভিহিত করেন। এই অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য অনেকে কাউন্সেলিংও করে থাকেন, পার্সোনালিটির এই বৈশিষ্ট্য সহজাত।
আত্মমগ্নতা আর আত্মপ্রেম শুনতে কাছাকাছি মনে হলেও দুটো টার্ম একে অন্যের বিপরীত। আত্মমগ্নতায় নিজেকে নিয়ে অহংকার করার বিষয় নেই, বরং নিবিষ্ট পরিচর্যায় নিজেকে শুধরানোর সুযোগ রয়েছে। গভীর অভিনিবেশে নিজের সাথে কথা বলার, প্রশ্ন করার, নিজের বোঝাপড়াটা ঝালাই করে নেওয়ার সুযোগ আছে, এটি সর্বৈব ইতিবাচক। আত্মমগ্নতা চর্চার মাধ্যমে আয়ত্তে আনা সম্ভব, এটি স্বভাবগত নয়।
যদিও গুটিকয়েক শব্দবন্ধে ঠিক আত্মনিমগ্নতাকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। ব্যক্তি তথা সমাজজীবনে এর ব্যাপ্তি ও ক্ষেত্র বহুল প্রসারিত। সহজ করে বললে বলা যায়- ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইতিবাচক উদ্যোগের মাধ্যমে নতুন করে নিজেকে চেনা-জানার সুনিবিড় পর্যবেক্ষণের নামই আত্মমগ্নতা। বস্তুত এটি চিন্তার জগতে এক নতুন সন্নিবেশন এবং চিন্তাশীলতার এক সুসংহত প্রক্রিয়া।
পাঠক হয়তো ভাবছেন আত্মমগ্নতা চর্চা করে কী লাভ? এখন সেদিকেই আলোকপাত করছি। সৃষ্টিগতভাবেই প্রতিটি মানুষ অপার সম্ভাবনার অধিকারী। যা একজীবনে সকলে জানতে পারে না, জানতে চায়ও না, কিংবা পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে জানাটা হয়ে ওঠে না। অথচ, প্রতিনিয়তই মানুষ খুব সহজে নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করেন নিজের অকৃতকার্যতার জন্য, সন্তানদের সঠিকভাবে মানুষ করতে না পারার জন্য। ভালো স্বামী -স্ত্রী-মা না হতে পারার জন্য। এই ব্যর্থতার খতিয়ান যত বাড়ে জীবনে তত বেশি চাপ যুক্ত হয়। এ চাপ সহ্যসীমা ছাড়িয়ে গেলে শরীরেও এর নানাবিধ প্রভাব পড়ে। তাই, নিজেকে ভালো রাখতেই নিজের প্রতি যত্নশীল হতে হয়। আর এই যত্ন নেওয়ার জন্য নিজের স্বত্তাকে নতুন করে আলাদা আইডেনটিটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। নিজের ভেতরে ডুব দিতে পারলে জাগতিক অন্য সকল বেদনার ভার অতি তুচ্ছ হয়ে যায়। বস্তুগত লাভালাভ, ভোগবিলাস, সফলতা, অর্জন সবকিছুই অতি ক্ষুদ্র ভেতরের ‘আমি’র অপার বিস্ময়ের কাছে। নিজে কী করতে, কী পরতে, খেতে, কোথায় বেড়াতে যেতে কিংবা কার সাথে আড্ডা দিতে পছন্দ করি আমরা প্রায় ভুলেই থাকি আমাদের জীবন যাপনের পদ্ধতির কারণে।
নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এমন অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে পারেন, তবে নারীদের ক্ষেত্রে এবং বিশেষভাবে বাংলাদেশি নারীদের ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতা ঘরে ঘরে সমানভাবে সত্য। ব্যতিক্রম ছাড়া এই কিছুদিন আগেও বিবাহিত নারীদের পরিচয় ছিল কারো মা, কারো স্ত্রী কারো চাচী-মামী, কারো বা পুত্রবধূ। এর বাইরে তাঁদের যে একটা নাম ছিল তাও তাঁরা ভুলে যান। শহরকেন্দ্রিক সমাজ বাদ দিলে এখনও চিত্র মোটামুটি একইরকম।
অনেকসময় বিলাসবহুল জীবনকে আমরা অর্জন ভেবে তৃপ্তি অনুভব করি। ভোগবাদীতা জীবনে সন্তুষ্টি যেমন আনে তেমনি ভোগের প্রসাদ আহরণে জীবনে ইঁদুর দৌড় খরগোশদৌড় সবই হয় নিত্যসঙ্গী। এই দৌড়ের কোনো থামা নেই, নেই ক্লান্তিও। কেবল কাঙ্ক্ষিত পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছানোই লক্ষ্য। এই পাহাড় জয়ের নেশা এক ভয়াবহ আসক্তি। এতে আক্রান্ত হয়ে মানুষ হয়ে পড়ছে বিচ্ছিন্ন। অধিক কোলাহলেও সে থাকে শব্দহীন। পরিবার পরিজন থাকলেও সে আদতে একা।
আবার একথাও তো সত্য ব্যক্তির জীবন কেবল ভোগবিলাসে মধ্যে নিহিত থাকলে জীবজগতের অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় সেই জীবনের আলাদা কোনো মাহাত্ম্য থাকে না। মানবজীবন তো কেবল যাপনের নয়, উদযাপনেরও। মানুষ যখন জীবনকে উদযাপনের সেই আনন্দটুকুই খুঁজে পায় না তখন ভোগটাও উপভোগ্য হয় না।সুতরাং জ্ঞানার্জন ও কল্যাণমূলক কার্যক্রম হতে পারে আনন্দ উৎপাদনের উৎস।
সক্রেটিসের, ” Know thyself”কে অনুসরণ করেই মূলত আত্মমগ্নতার পথে অগ্রসর হওয়া যায়। তিনি বলেছেন, “নিজেকে আবিস্কারের মধ্য দিয়েই জ্ঞান আহরণের রাস্তা খুলে যায়। তাঁর কাছে প্রতিটি মানুষেরই জ্ঞান অর্জনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা উচিত কেননা জ্ঞানার্জন হল সর্বোৎকৃষ্ট মানবিক মানুষ হয়ে ওঠার পূর্বশর্ত।“ জ্ঞানার্জনের প্রাথমিক ধাপ ব্যাক্তির আত্মসচেতনতা। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব যেমন আলাদা তেমনি প্রত্যেক ব্যক্তির চিন্তা করার প্রক্রিয়াও আলাদা। একটি থট প্রসেসের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি আত্মসচেতনতার ধারনালাভ করে। যেখানে ব্যক্তি তাঁর সবল ও দুর্বল দিকগুলো বুঝতে পারে, নিজস্ব পছন্দ অপছন্দগুলো চিহ্নিত করতে শেখে, জীবনে প্রায়োরিটি তথা লক্ষ্য নির্ধারণ করতে শেখে। সর্বোপরি নিজের মূল্য সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হয়।
আত্মনিমগ্নতাকে ধ্যানমগ্নতার সাথেও তুলনা করা যায়। তবে, আত্মনিমগ্ন হতে হলে সংসার বিবাগী হতে হয় না, গহীণ গুহায় গিয়ে ধ্যানরত হয়ে কালযাপনেরও দরকার পড়ে না। কিংবা স্বার্থপর হয়ে চারপাশে কী ঘটছে তা থেকে নিজেকে গুটি য়ে নিয়ে একলা অন্ধকারে বসবাস করারও দরকার হয় না। দরকার শুধু নিজেকে বুঝে ওঠার জন্য ভেতরে ভাঙাচোরার। নিজেই নিজের প্রশ্নকর্তা বনাম উত্তরদাতা হিসেবে বসিয়ে একটা মিমাংসিত সহাবস্থানে আসতে হয়। প্রতিদিন নিজের সাথে কথা বলার জন্য সময় তুলে রাখা, নিজেকে স্বীকৃতি দেওয়া, উৎসাহ দেওয়া, ধন্যবাদ দেওয়া, নিজেই নিজের প্রেমে পড়া। অন্যের অনুমোদনের অপেক্ষা না করেই নিজেই নিজের সকল কাজের বিচারক হওয়া। এভাবেই বিশুদ্ধ আত্মমগ্নতায় নিজেকে নিমজ্জিত করা সম্ভব।
মানুষ যদি নিজের সাথে বোঝাপড়ায় উত্তীর্ণ হতে পারে তখন হিংসা দ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, স্বার্থপরতা বিষয়গুলো থেকে বেরিয়ে এসে নিজের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা সুপ্ত সম্ভাবনাকে আলোতে নিয়ে আসতে পারে। নতুন প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে। মানুষের ধর্মবোধ, সমাজ, সংসার, সম্পর্ক, ও সামাজিক অন্যান্য বাস্তবতা বিষয়ে মত বদলায়, জটিলতা নিরসণ হয়, মনের ভেতরে জমে থাকা ক্লেদ দূরীভূত হয়। অন্যকে ক্ষমা করতে শেখে, এবং অতি অবশ্যই পরচর্চা থেকে দূরে থাকতে পারে। কারণ তখন সে কেবল নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। মানুষ নিজের ক্ষমতা চিনতে পারলে, নিজের অতলের মণিমুক্তার সমুদ্রে সন্তরণ করতে পারবে সহজেই।
যেহেতু আত্মনিমগ্নতা আত্মকেন্দ্রিকতার ঠিক বিপরীত, সেহেতু একে আত্মশুদ্ধির এক বিশেষ প্রক্রিয়া বলা যেতে পারে।এই সাধনা জাগতিক অন্যসবকিছুর মোহ থেকে তুলে এনে আপনাতেই নিমজ্জিত করে। ফলে আপন মোহে মোহিত হয়ে এক জীবন অতি স্বচ্ছন্দ্যে পার করা যায়। এর সাথে খানিকটা হরমোনের সম্পর্ক আছে। এড্রিনালিন গ্রন্থের ক্ষরণ ও নিঃসরণ প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে প্রজেস্টোরন এবং টেস্টেস্টেরন নিঃসরণের তারতম্যও ব্যাপক ভূমিকা রাখে, যা পরীক্ষিত। তবে, সৃষ্টিশীল মনন ও পরিশীলিত আবেগ দিয়ে আত্মমগ্নতায় সফল হওয়া যায়।
আত্মমগ্নতার অনেক সুফলের সাথে এটিও মাথায় রাখতে হবে যেন নিজেই নিজের প্রেমে মগ্ন হয়ে নার্সিস্টিক না হয়ে যান, সেদিকে সচেতন থাকা জরুরি। পরিশেষে বলছি-আজকের দুনিয়ার এই শো আপ সংস্কৃতিতে আত্মমগ্নতা অধিক বেশি কার্যকরী। প্রতিযোগিতা, ঈর্ষাকাতরতা, হিংসা, বিদ্বেষ, কলহে জড়ানোর চেয়ে নিজেকে আবিষ্কারের আনন্দ অনেক সুলভ এবং খাঁটি।
আত্মমগ্নতার সাথে আত্মমর্যাদা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মোপলব্ধির প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। এই চর্চা চালিয়ে গেলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে। প্রতিদিন নিজেকে নিজেই ছাড়িয়ে গিয়ে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার পথে ক্রমশঃ পা রাখা যায়। কেননা, কেবল মানবশিশুকেই আজীবন মানুষ হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হয়। সুতরাং, মানবজীবনে আত্মনিমগ্নতার উপলব্ধি যত দ্রুত হয় সমাজ, সম্প্রদায়, রাষ্ট্র, দেশ এবং সর্বোপরি নিজের কল্যাণে তত দ্রুতই কাজ করা যায়।