গানে আর গল্পে অঞ্জন দত্ত
মাহমুদুজ্জামান সোহান ঃ কালো ক্যাপ, কালো শার্ট , জিন্স প্যান্ট আর হালকা কালো ফ্রেমের চশমায় অঞ্জন দত্ত যখন কোনো কথা বার্তা ছাড়াই সরাসরি শুরু করলেন “সেই বুড়ো পুরোনো গিটার, দিয়েছে কত কিছু দিয়েছে” গানটা, ঘড়ির কাঁটা ঠিক তখন ৭:৪৫ এ। পুরো অডিটোরিয়াম গলা ফাটিয়ে স্বাগতম জানালো, গাইলো একসাথে। গান শেষে একটু চুপ থেকে আস্তে আস্তে গল্প করার ভঙ্গিমায় কথা বলতে শুরু করলেন, এই বুড়ো পুরোনো গিটারটা কি দিয়েছে তার গল্প।
গত ২০ এপ্রিল টরন্টো প্যাভিলিয়নে গা্ন গাইতে এসেছিলেন ক্যাতিমান শিল্পী অঞ্জন দত্ত। গানের ফাঁকে ফাঁকে শিল্পী তুলে ধরছিলেন জীবনের আঁকা বাঁকা পথের নানা গল্পকথা।
” শুরুতে গানটা কিন্তু আমার একেবারেই আগ্রহের জায়গা ছিল না। আমার প্রচন্ড ভালোবাসার জায়গা ছিল অভিনয়। কিন্তু অভিনয়ে জায়গা পাওয়া কঠিন হয়ে গেলো। একটা বিশেষ মহল মানে এই যেমন বুদ্ধদেব দাস গুপ্ত, অপর্ণা সেন কাজ দিয়েছে। কিন্তু তারাই বা আমাকে নিয়ে কতবার করবে বলুন? বছরে একটা করে ছবি করি এবং অল্প টাকার ছবি। এবং সেগুলো হলে ভিড় করে সবাই দেখতোও না। আর্ট সিনেমা। কি করে হবে? বয়স বেড়ে যাচ্ছে, ধার বেড়ে যাচ্ছে, বিয়ে করে ফেলেছি। আমার সন্তান হয়ে গেছে। কিছু তো করতে হবে আমাকে। আমি তখন ভাবলাম, আচ্ছা সুমন (কবির সুমন) তো গান করছে গিটার নিয়ে। একা একা কিছু গান লিখেছিলাম, একটা এক্সপেরিমেন্ট করার জন্যে। আমার বায়ে বসা ছেলে, নীল দত্ত। ওর তখন ১২ বছর বয়স। ও তখন আক্ষরিক অর্থে মিউজিক শিখেছে। অনেকগুলো টিচারের কাছে। তার মধ্যে একজন আমার ডানে বসা আছে অমিত দত্ত। তো আমি তখন ছোট্ট করে একটা অনুষ্ঠান করি। আমাদের সিনেমার লোকজন, তারা শুনতে আসে। তারা বলে, খুব ভালো অঞ্জন, গান করো, গান করো। মৃণাল বাবু, অপর্ণা সেন।
এবং সেইখানে একটি ছেলে আসে, এখন সে খুব নাম করা ফিল্ম মেকার, ডিরেক্টর- সুমন মুখোপাধ্যায়। বলে অঞ্জন দা, যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে একটা শো -করবেন?
–কবে?
-এই সামনের শনিবার। ৫০০০ টাকা দেবো।
সেটা ১৯৯৩ সাল। ৫ হাজার টাকা নিয়ে আমি আর নীল গিয়ে ২ ঘন্টার শো করি। সেখান থেকে মেডিকেল কলেজ বলছে, আসবেন? সাত হাজার টাকা দেব। সেখান থেকে কোথায় জলপাইগুড়িতে একটা অনুষ্ঠান, বলে দশ হাজার টাকা দেব। আমি করছি, বাহ্ এটা মন্দ নয়।
সুমন (কবির সুমন) ও বলছে,হ্যাঁ, গান করো, করো, করো, তুমি ভালো গান লেখো। আমি তো মিউজিকটা কোনোদিন শিখিনি। কিন্তু এই যে যেটা শিখলাম, যেটার জন্যে সময় দিলাম, খরচা করে দু বছর অভিনয় শিখেছি আমি বাদল সরকারের কাছে, যেটার জন্যে খাটলাম আমি সেইটা আমাকে সেই অর্থে যা না দিলো, যেটা মন দিয়ে করিনি, ভালোবেসে করেছি সেটা অনেক অনেক বেশি আমায় দিয়েছে। কিন্তু এটা আমি অনেক বছর, বেশ কিছু বছর মানতে পারিনি। অভিমান ছিল আমার। এইজন্য আমার গানে দেখবেন একটা অভিমান আছে। একটা ব্যাংকের কেরানি – অভিমান, একটা মিউজিসিয়ান – অভিমান, অভিমানটা আমার ভেতরে। সেই দিনটা আস্তে আস্তে কমে এলো। আমার ধার শোধ করে দিলো। আমায় অনেক কিছু দিয়েছে, যার জন্যে একটুও খাটি নি। এই গানের বদৌলতে কত পৃথিবীর জায়গা আমি দেখলাম? এখন সাউন্ড অফ মিউজিকের দৌলতে প্রথমবার টরোন্টোতে এলাম। সাদা মাটা মানুষের গান। এমন কিছু বলেনা আমার গান। আমার চার পাশের মানুষদের নিয়ে গান। ”
আস্তে আস্তে গিটারের টুং টাং শব্দ বাড়তে থাকলো আর গান ধরলেন
“জ্বলছে নিভছে নিয়নের বিজ্ঞাপন,
বৃষ্টিতে ভিজে গেছে রাস্তা, ভেজা ভেজা মন,
লাস্ট ট্রাম ধরে ঘরে ফিরবে আবার স্যামসন,
সাথে সঙ্গী শুধুই স্যাক্সফোন। ”
পুরো হলভর্তি দর্শক শ্রোতা গলা মেলাচ্ছে মাঝে মাঝেই পুরো গানটা জুড়ে। গান শেষে আবার ফিরে গেলেন গল্পের আসরে
“এরপর এইচ এম ভি এসে বলে, সুমনও খুব করে বলে, অনেকেই বলে রেকর্ড করার। আমি রেকর্ড করি। আর রেকর্ড করার পরে তো আমাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। তো ১৯৯৪ এ আমি রেকর্ড করি আর ১৯৯৯ এ আমি প্রথম বাংলাদশে যাই। সেখানে গিয়ে আমি রিয়ালাইজ করি যে আমার ৫০ ভাগ অডিয়েন্স তো বাংলাদেশে। আমার দেশের লোকতো শুনছেই, তারা নিয়ে যাচ্ছে, অনুষ্ঠান করাচ্ছে, they really loved me। কিন্তু তারা আবার বলছে আমরা আপনার ছবি দেখেছি সিনেমা দেখেছি, কিন্তু গানটা, ওটাই। ( অভিনয়টা নয় গানেই মন দাও )। যাই হোক , বাংলাদেশে গিয়ে আস্তে আস্তে I came to terms যে, না, আমার গানটা করতে হবে সিরিয়াসলি। ততোদিনে এলবাম বের করেছি, সিরিয়াসলিই করেছি, কিন্তু আরো সিরিয়াসলি করতে হবে । তখন বাংলাদেশ থেকে একটা এলবাম বেরোলো, আপনারা শুনেছেন কিনা? আমার প্রিয় একটা গান, এই যে ৫০/৫০ অডিয়েন্স আমার দুই প্রান্তে এদেরকে নিয়ে একটা গান”
আস্তে আস্তে গিটারের আওয়াজ বাড়তে থাকলো, অঞ্জন দত্ত গান ধরলেন
“বেইলি রোডের ধারে আমি দেখেছি তোমায়, /রাতের অন্ধকারে আমি দেখেছি তোমায়, /আমার বৌবাজারে আমি দেখেছি তোমায়, /দুদিকের কাঁটাতারে আমি দেখেছি তোমায়”
গানের মাঝে মাঝে দর্শক গলা মিলাচ্ছে আবার হল কাঁপিয়ে করতালি দিচ্ছে। কি নিবিড়ভাবে দর্শক শ্রোতা মুগ্ধ হয়ে শুনছে অঞ্জর দত্তের গান।
তিনি আবার ফিরলেন গল্পে-
” এই গান করতে তো অনেক জায়গায় গিয়েছি। প্রথমে তো একা একা গান করতাম। তারপর একটা ব্যান্ড হলো সময়ের সাথে চলার জন্যে। কিন্তু বয়স যত বেড়েছে, আমার মনে হয়েছে আমার গানগুলো একটা ইন্টিমেট কথা বলছে, সহজ কথা। আমাকে সুমন একবার বলেছিলো , you know, you have a strange sense of humour and very subtle sadness। এটা কোনোদিনও তুমি হারিও না অঞ্জন। এটার জন্যই আমার মনে হয়েছে, একটা ইন্টিমেট জায়গায় এসে ইন্টিমেটভাবে শুধু দুজন ভাল মিউজিশিয়ান, শুধু গিটার নিয়ে আমার গানগুলো করবো। তো সেটার জন্য আমরা ডিসাইডেড যে আমরা এই তিন দত্ত মিলে করবো। তো আমরা গান করছি এখানে ওখানে, এদেশ ওদেশ যাচ্ছি কিন্তু যে দেশটা, জায়গাটা দেখার ইচ্ছা ছিল, সেখানে যে আসতে পারবো এই ইন্টিমেট দলটাকে নিয়ে আসতে পারবো সেটা ভাবিনি। এইজন্য আয়োজকদের অসংখ্যা ধন্যবাদ।
গান ধরলেন-
“কানে বাজে এখনো পুরোনো সে পিয়ানোর ঝংকার,
নিকোটিনে হলদে হয়ে যাওয়া দশটা আঙ্গুল,
সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে একশো মাইলের গানটা,
একশবার শুনে একশবার হতো ভুল ”
………………
“If you miss this train I ‘m on / You will know that I have gone/You can hear the whistle blow /A hundred miles”
গান শেষে কেউ একজন দর্শক সারি থেকে চিৎকার করে বললো ” বেলা বোস”। হাসির ছলে অঞ্জন দত্ত আবার গল্পে ঢুকে গেলেন –
” দেখুন ইন্টিমেটটা ইন্টিমেটই থাকুক, মনে মনে কথা হচ্ছে, আমি তো জানি এটা আমাকে গাইতে হবে। আপনার কারোর যদি বাড়ি যাবার তারা থাকে কিছুই আমার করার নেই (হাসতে হাসতে ), আরো কিছু গান শুনলে তারপর হয়তো গাইবো। অনেকদিন থেকে এই মহিলাকে বোস বোস বোস করে বসতে বলা হচ্ছে কিন্তু বসছে না। আরো কত মেয়েদের নিয়েই তো গান লিখেছি কিন্তু সবাই এই, বেলা বোস।
এ পর্যায়ে অঞ্জন দত্ত চেয়ার ছেড়ে উঠে স্টেজের হালকা নীল আলোর পাশে একটু অন্ধকার কোনায় আস্তে আস্তে পায়চারি করতে থাকলেন। খানিক পর ফিরে এলেন গান আর গল্পের কাছে। মাঝের সময়টা অবশ্য ছেলে নিল দত্ত মাতিয়ে রাখলেন আসর।
গল্পই শুরু করলেন তিনি, কিছু মানুষকে থাঙ্কস জানানো প্রয়োজন। ব্যক্তিগত ভাবে এখানে তো আমি হেটে হেটে আসিনি। প্লেনে করে এসেছি। বিমান বাংলাদেশ স্পনসর করেছে। থ্যাংক ইউ বিমান বাংলাদেশ। ফান পার্ট হচ্ছে যে আমি বিমান বাংলাদেশে অনেকবার চড়েছি কিন্তু বিমান বাংলাদেশে করে এতো লম্বা জার্নি কখনো করিনি। তো যেকোনো কারণে একটু ডিলে হচ্ছিলো তো আমি ক্যাপ্টেনকে বলি যে, ক্যাপ্টেন, আপনিই তো কিং অফ দা এয়ারক্রাফট, দেখেন কিছু করা যায় কিনা। ক্যাপ্টেন বলে যে দেখছি। কিছুক্ষন পরে এয়ারহোস্টেজ এসে বলছে , যে ক্যাপ্টেন আপনাকে ডাকছে। আপনি কি একটু ককপিটে যাবেন ? আমি উঠে গেলাম। দরজা খুলে ভেতরে যেতেই ক্যাপ্টেন বেশ উৎফুল্ল হয়ে বলে, ছোট বেলা থেকেই আপনার গান শুনে যাচ্ছি, সিনেমা দেখে যাচ্ছি। দিস ইজ মাই অফিস। সিট্ ডাউন। কি লাগবে বলুন। তবে আপনি যেটা চাইছেন সেটা আমি দিতে পারবো না (সবার হাসি ) কিন্তু এই সক্কাল বেলা আপনাকে এক কাপ গ্রেট কফি সার্ভ করতে পারবো। তারপর অনেক্ষন ধরে কফি খেলাম এবং উপর থেকে দেখলাম কানাডা- এপ্রোচিং । ওয়ান্ডারফুল। এরা বন্ধু হয়ে যায়। বন্ধু এভাবেই হয়। এরপর ও আমার নাম্বার নিলো, আমি ওর নাম্বার নিলাম। ক্যাল্গেরী গিয়েও বন্ধু হয়ে গেল, এখানেও বন্ধু হয়েছে। বন্ধুত্বটা খুব ইম্পরট্যান্ট। আমার কিন্তু কম বন্ধু কিন্তু যারা সত্যিকারের বন্ধু তারা কিন্তু অনেকদিনের বন্ধু হয়ে যায়। এখন কম বন্ধু বলতে এই এই একহাজার লোক কি আমার বন্ধু নয়? তারা কি আমার গান শুনছে না? ডেফিনিটলি। আই কিপ ইন টাচ। এইযে আপনারা সবাই চুপ করে শুনছেন, এটা একটা গান হয়ে যাচ্ছে। এমনভাবেই গান হয়ে যায়।
গিটারটা বেজে উঠলো, সাথে গান শুরু করলেন “ছাদের ধারের রেলিংটা, সেই দুস্টু দো দো সিড়িঙটা, আমার শৈশবের দার্জিলিংটা” খুব ধীর লয়ে প্রায় ১০ মিনিট ধরে গানটা গাইলেন। মনে হলো একটা খুব গভীর অনুভতি থেকে ভীষণ ভালোবেসে গানটা গাইলেন। সাথে যথারীতি অমিত দত্তের অসাধারণ গিটার।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে এসে গাইলেন বেলা বোস গানটি
” চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছো,
এখন আর কেউ আটকাতে পারবেনা,
গান শেষে আবার কথা বলতে শুরু করলেন।
“টেলিফোনের গান কখনও ফেইল করে না। দেখবেন –
” I just called to say I love you” , / “Hello, my friend, hello”
হ্যালো হ্যালো গানগুলো সবসময় হিট হয় ।
তা যাই হোক, আমার মনে হয়েছে এই বেলা বোস গানটা সামহাউ সেন্টিমেন্টাল। এটা নস্টালজিক, কিন্তু সেন্টিমেন্টাল। আমি পার্সোনালি ফিল যে এই গান যদি আজকে লিখতাম, তাহলে অন্যভাবে লিখতাম। একটা মেয়ে উত্তর দিচ্ছে না। সে সিঁদুর ফিদুর পরতে রেডি অন্য কারোর সঙ্গে। অথচ লোকটা বেলা বোস’কে দিন, বেলাকে দিন, বেলাকে দিন – বলেই যাচ্ছে। এটা আমি না। আমি যদি আজকে লিখতাম, কি হতো সেটা শুনুন;
হালো হ্যালো হালো তুমি শুনতে পাচ্ছে কি
নেটওয়ার্ক এখানে খুবই দুর্বল
অনেকদূর থেকে অনেকক্ষন করছি
চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি গতকাল
হালো হ্যালো হালো তুমি শুনতে পাচ্ছে কি
নেটওয়ার্ক এখানে খুবই দুর্বল
অনেক ভেবে অনেকদূর থেকে থেকে ফোনটা করছি
চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি গতকাল
চাকরি করে গানটা করা হচ্ছে না যে আর
তাই বেছে নিলাম আমার নিজের গান
আমি পারবোনা দায়িত্ব নিতে অন্য কিছুর আর
তুমি যতই করো মান অভিমান
বিদিশা, I am sorry, I am sorry, sorry, sorry Bidisha
মেনে নাও তোমার বাবা মার কথাটাই ঠিক
আমি পারবোনা দিতে তোমাকে একটা লাল নীল সংসার,
বিদিশা, আমার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত
আমার গানের প্রেমে পরে আমায় ভালোবাসা
রাস্তা ঘাটে মাঠে বেড়িয়ে,
আজ প্রেমটা হয়ে গেছে তোমার কাছে অনেক বড়ো
আর গানটা গেছে অনেক পিছিয়ে
আজ বড় হয়ে গেছে তোমার কাছে গাড়ি বাড়ি
ঘর সাজাবার বাজার আসবাব
আমি চেয়েছিলাম শুধু তোমার মনের কাছে আসতে
তুমি চাইলে আমার যাবতীয় সব।
বিদিশা, I am sorry, I am sorry, sorry, sorry Bidisha
মেনে নাও, তোমার বাবা মার কথাটাই ঠিক
আমি পারবোনা দিতে তোমাকে একটা লাল নীল সংসার,
বিদিশা, আমার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত (২)”
তুমুল করতালির মাধ্যমে এই একেবারে নতুন গানটি শেষ করলেন।