‘কালার ইট- ইটস লাইফ !’
সঙ্গীতা ইয়াসমিন : প্রতিবছর বিশ্ব অটিজম দিবস এলেই আমার কিছু লিখতে ইচ্ছে করে। ভাবি কিছু দায় আছে আমার, কিন্তু কেন জানি না লেখা আর এগোয় না। অন্য যেকোনো বিষয়ের মত সাবলীলভাবে এই বিষয়টি নিয়ে লিখতে পারি না। কলম থেমে যায় কোথাও, আমিও রয়ে যাই ধূসরতায় আচ্ছন্ন অন্ধকারে। ‘কালার’ নিয়ে লিখতে এসে ধূসর শব্দটি আনলাম এ কারণে যে, নীলের অনেক কাছাকাছি এই ধূসর। নীল থেকে নীলাভকে তুলে নিলে দেখবেন পড়ে থাকে কেবলই ধূসর।
২০২৩ এ বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবসের থিম–‘কালার’ – এ বছরের জন্য নীল রঙ নির্ধারিত হয়েছে। সাহিত্যের ভাষায় নীল বেদনার রঙ। মনোচিকিৎসার ভাষায় নীল মন খারাপের রঙ। মানুষের মুড পরিমাপের জন্য লাল হলুদ নীল সবুজ রঙের অর্ডারে জোন ভাগ করা হয়, যা মুডমিটার বা মুড স্কেল হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। এই স্কেলের অতিমাত্রা লাল, মাঝারি মাত্রা হলুদ আর নীল তার পরের মাত্রা যা অনেকটা নিস্পৃহতাকে নির্দেশ করে। সবুজ জোন হল এই স্কেলের শেষ মাত্রা যা কি না সমাজের নির্ধারিত সংজ্ঞায় স্বাভাবিক। জেনে রাখা দরকার, অটিজম সম্পন্ন মানুষেরা খুব স্বাভাবিকও থাকে বৈকি!
বস্তুত অটিজম অনুধাবনের জন্য প্রতীক হিসেবে রঙধনু রঙ ব্যবহৃত হয়ে আসছে বহুদিন আগে থেকেই। রঙধনুর রঙে যেমন বৈচিত্র্য আছে অটিজমেও তেমনি বৈচিত্র্য আছে। কোনো একক বৈশিষ্ট্য দিয়ে একে যেমন চিহ্নিত করা যায় না তেমনি একে সমাজের মূলধারায় অন্তর্ভুক্তির জন্যও দরকার নানা ধরনের বর্ণিল আয়োজন। বলা ভাল অটিজম বুঝতে হলে রঙিন হতে হয়, রাঙিয়ে দেবার ইচ্ছা থাকতে হয়।
অটিজম থীম –‘কালার’ এর সাথে ‘লাইট আপ দ্য ব্লু’ স্লোগানকে সামনে রেখে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস ২০২৩ উদযাপন করবে এবছর এপ্রিলকে অটিজম মাস হিসেবে। ব্লু লাইট আপ বলতে বোঝায়-খানিকটা নিস্পৃহ, নিভৃত মনকে আলোকিত করে দেওয়া, কিংবা আলোয় টেনে নিয়ে আসা। মোদ্দা কথা আমাদের আশেপাশে যেসব অটিজমসম্পন্ন মানুষ আছে তাঁদের জীবনযাপনে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটানো। তবে এই আলোক সঞ্চালন প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে রাষ্ট্র-সমাজ-কমিউনিটি ও পরিবারের সম্মিলিত অনুধাবনই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। ফলত আমাদের বর্ধিত জনগোষ্ঠীর এই বিশ্বে মোট জনসংখ্যার এক শতাংশ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে আমাদের উপলব্ধি কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখবে।
যদিও এই অনুজ্জ্বলতা কিংবা অপেক্ষাকৃত ধূসরতা নিয়েও বহু প্রশ্ন আসতে পারে। কোনটা কেন উজ্জ্বল আর কোনটা কেন অনুজ্জ্বল তা নিয়েও বিতর্ক চলতে পারে। তবে দিনশেষে আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে শিশুর অটিজম চিহ্নিত হবার পর পরই তাঁকে প্রয়োজনীয় সুনির্দিষ্ট কর্মকাণ্ডের মধ্যে নিয়ে আসতে পারলে অনেক সম্ভাবনার পরিস্ফুটন ঘটানো সম্ভব হয়। আর স্বাভাবিক জীবনযাপন তো সম্ভবই। তবে, হ্যাঁ সেক্ষেত্রে অটিজম স্কেলের মাত্রাও বিবেচনাযোগ্য। অতিমাত্রায় অটিজম হলে পরিবর্তন খুব সহসা আশা করা যায় না এটা রূঢ় বাস্তবতা।
যেহেতু অটিজমের কারণ ও তার প্রতিকার নিয়ে এখনও অব্দি চিকিৎসা বিজ্ঞান কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেনি সেহেতু অটিজমসম্পন্ন শিশুদেরকে সমাজের মূলধারায় অন্তর্ভুক্তির জন্য সবরকম প্রচেষ্টা চালানোই এখন একমাত্র করণীয়। অটিজম সংক্রান্ত বিশ্ব পরিসংখ্যানে দেখা গেছে বর্তমানে বিশ্বের ৭৫ মিলিয়ন মানুষ অটিজমসম্পন্ন, যা বিশ্ব জনসংখ্যার এক শতাংশ। ২০০০ সালের পর থেকে অটিজম প্রবণতার হার ক্রমবরধমান যা ১৭৮%, ২০২১ সালে প্রতি ১০০ জনে একজন শিশু অটিজম হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি অটিজম চিহ্নিত দেশ কাতার, আর সবচেয়ে কম অটিজম চিহ্নিত দেশ ফ্রান্স। মেয়ে শিশুদের তুলনায় চারগুণ ছেলে শিশু অটিজম নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।
এ তো গেল অটিজম বিষয়ক বিশ্ব পরিসংখ্যান। এবার আসি নিজের বাড়ি। কানাডায় এক থেকে সতের বছর বয়সী প্রতি ৫০ জন শিশুর মধ্যে একজন শিশু অটিজম সম্পন্ন। এই অটিজম সম্পন্ন সন্তানদের কারণে এই কানাডাতে প্রতিবছর কত হাজার হাজার পরিবার অভিবাসিত হয়ে আসেন তা আমাদের অজানা। কেননা এই সমাজে মানুষই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সে মানুষ হোক প্রতিবন্ধী কিংবা মনোরোগী। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অটিজম সম্পন্ন মানুষদের জন্য চিকিৎসা পরিসেবাসহ শিক্ষা ও কমিউনিটি এনগেজমেন্টের বহুমুখী কর্মসূচী রয়েছে, যা স্কুল উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই অন্তর্ভুক্ত।
এতোসব ইনক্লুসিভ কর্মকান্ডের পরেও অটিজমসম্পন্ন শিশুরা নির্যাতিত হয়ে থাকে মানসিক আবেগিক ও মৌখিকভাবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমরা ইউরোপ আমেরিকায় থাকি, আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সন্তান সন্ততিদের জীবনেও সাফল্য আসে। তবে আমাদের মনের ভেতর থেকে পুরাতন জঞ্জাল সরিয়ে সএমপ্যাথির বীজহজে বপন করতে পারি না। সেই শিক্ষা আদতে আশৈশব আমরা পাই না। আমরা আমাদের সংস্কৃতির অনেককিছুই যেমন ভুলতে পারি না, তেমনি নতুন দেশ তথা সংস্কৃতির এই উদারতার জায়গাগুলোও সহজে গ্রহণ করতে পারি না। সেকারণেই আরও বিস্তৃত পরিসরে সচেতনতা বিষয়ক কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত এই মাল্টিকালচারাল সমাজের জন্য।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, আমাদের বর্তমান প্রভিন্সিয়াল সরকারের কাছে স্কুল একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। তিনি স্কুল থেকে কোনো প্রফিট পাচ্ছেন না বিধায় শিক্ষক ছাঁটাই, বাজেট কর্তন এবং কিন্ডারগার্টেন থেকেই ভার্চুয়াল স্কুল চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যাতে করে অটিজম সম্পন্ন শিশুরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আদতে অটিজম সম্পন্ন মানুষ রাষ্ট্রের বোঝা। তাঁরা সমাজকে দিতে পারে না কিছুই, উপরন্তু রাষ্ট্রকেই তাঁদের পেছনে ব্যয় করতে হয়।
অন্যভাবে দেখতে গেলে অটিজমসম্পন্ন মানবেরা অতিমাত্রায় মানবিক বোধসম্পন্ন হয়। তাঁরা মিথ্যাচার বোঝেন না। তাঁরা সামাজিক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াতে পারেন না। ইতিহাস ঘাঁটলে সহজেই কিছু বিখ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ নাম উঠে আসে যারা শৈশবে অটিজম নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে আলবার্ট আইন্সটাইন, এমিল ডিকেনসন, আইজ্যাক নিউটনসহ বিল গেটসও অটিজমসম্পন্ন শিশুমানব। সুতরাং সরকার বাহাদুর চাইলেই আরও একটু প্রসারিত করতে পারেন তাঁর উদারতার হস্ত, এবং এদের ভেতর থেকে একদিন বেরিয়ে আসতে পারে আরও কোনো আইনস্টাইন কিংবা নিউটন বিশ্বব্যাপী মানবকল্যাণে অবদান রাখতে।
পরিশেষে বলছি আপনাকে-আপনাদেরকে আসুন না আমাদের চারপাশে একটু খামতি আছে এমন শিশুটির দিকে বাড়িয়ে দিই হাত। নিজস্ব লেন্সে না দেখে ওদের মত করেই দেখতে শিখি। কেবল ভালোবাসা-সমানুভূতিই বদলে দিতে পারে অনেক জীবন। আপনার অতি মেধাবী শিশুটির মত এই শিশুদেরও আছে সমাদৃত হবার অধিকার। আপনার আমার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মঙ্গল দীপ জ্বেলে উঠুক ওদের জীবনের ধুপছায়া অন্ধকারে। স্রষ্টার ইচ্ছের পুতুল ওরা- তবুও মানব জীবন! যাবার আগে রাঙিয়ে দিয়ে যাই।
সঙ্গীতা ইয়াসমিন। টরন্টো, কানাডা।