’বাংলাদেশের উন্নয়নে প্রবাসীদের ভূমিকা’ নিয়ে ওয়াশিংটনে সেমিনার
শাহিদ মোবাশ্বের, ওয়াশিংটন ডিসি থেকে: প্রবাসীদের অভিজ্ঞতা, পেশাগত খ্যাতি, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ স্থানীয় ব্যবসার জন্য অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। দেশের উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি অর্জনে প্রবাসীদের “জ্ঞান হস্তান্তর” ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। আর এই “জ্ঞান হস্তান্তর” হচ্ছে অর্জিত জ্ঞান, মেন্টরশিপ, পরামর্শ এবং অভিজ্ঞতা বিনিময়। এছাড়া মানবপ্রীতি, ব্যবসা এবং একাডেমিক নেটওয়ার্ক, ইন্সটিটিউশনাল লিংকিং ইনিশিয়েটিভস, বিভিন্ন সোর্স থেকে নিজ দেশে বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং টেকনিক্যাল পরামর্শের মত বিষয়গুলোতে প্রবাসীরা বিভিন্নভাবে অবদান রাখতে পারে।
গত রোববার ভার্জিনিয়ার টাইসন্স কর্ণারে বাংলাদেশী উদ্যোক্তার প্রতিষ্ঠিত ওয়াশিংটন ইউনিভাসির্টি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজিতে আয়োজিত “বাংলাদেশের উন্নয়নে প্রবাসীদের ভূমিকা” শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বক্তাগণ এসব কথা বলেন। তথ্য প্রযুক্তিতে অভিজ্ঞ প্রবাসীদের সংগঠন “বাংলাদেশী আমেরিকান আইটি প্রফেশনালস অর্গানাইজেশন্স -বাইটপো” এই সেমিনারের আয়োজন করে।
বাইটপোর প্রেসিডেন্ট শামসুদ্দিন মাহমুদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক আমির মোহাম্মদ নাসরুল্লাহ মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন।
অধ্যাপক আমির মোহাম্মদ নাসরুল্লাহ তার প্রবন্ধে বলেন, প্রবাসীদের অবদানের মূল ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে বিনিয়োগ, নেটওয়ার্কিং এবং অর্জিত জ্ঞান বিনিময়। সেক্ষেত্রে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান এবং প্রশিক্ষণ ব্যুরোসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ প্রবাসীদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে। তবে বাংলাদেশের উন্নয়নে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে একই পেশার লোকজনের সাথে সংযুক্ত হওয়ার উপায় সম্পর্কিত তথ্যে ঘাটতি রয়েছে।
প্রফেসর নাসরুল্লাহ বলেন, প্রথম ধাপ হিসেবে অন্যান্য দেশের মত ইন্টারনেটভিত্তিক একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে তার মাধ্যমে অর্জিত নলেজ ট্রান্সফার তথা জ্ঞানের বিনিময় করা যেতে পারে। এই নেটওয়ার্কের লক্ষ্য হবে প্রবাসে কর্মরত ও বসবাসকারী অত্যন্ত দক্ষ বিজ্ঞানী, পেশাজীবী, উদ্যোক্তা বাংলাদেশীদের একটি নিবন্ধনের আওতায় আনা এবং বাংলাদেশে কাজের সুযোগের উপর আপডেটেড তথ্য প্রদান করা। এক্ষেত্রে বাইটপোর মত সংগঠনগুলো সরকারের সাথে কাজ করতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বিশ্বব্যাংক গ্রুপের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রীপরিষদ সচিব মোহাম্মদ সাফিউল আলম বলেন, এ বিষয়টি সত্য যে দেশের আমলা ও পেশীশক্তিধারীদের মানসিকতার কারণে প্রবাসীরা দেশে গিয়ে ফলপ্রসূ কিছু করতে পারেনা। একারণে অনেক প্রবাসীরা দেশে কিছু করতে গিয়ে ফিরে এসেছে। নিউইয়র্ক ও হিউস্টোনে বসবাসরত পেশা ও ব্যবসায় সফল তার দু’জন বন্ধুর উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন তারা উভয়েই দেশে কিছু করতে গিয়ে কাষ্টমস, ইনকাম ট্যাক্স, ল্যান্ড অফিস, গ্যাসের অফিসে বিভিন্ন বাঁধার সম্মুখীন হয়ে হতাশ হয়ে ফিরে এসেছেন!
তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন সেক্টরে সেবা প্রদানকারীদের মানসিকতা অনুকুলে নয়। তারা আপনাদের সাহায্যের জন্য হাত বাড়াবেনা। তারা চাইবে আপনাকে আটকিয়ে কিভাবে কিছু আদায় করা যায়। তিনি বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭৪ সালেই বলেছিলেন – আমাদের কৃষক-শ্রমিকরা দুর্নীতি করেনা, আমাদের মত শিক্ষিত লোকেরাই দুর্নীতি করে। এটা এখনও সত্য। আমাদের এই দুর্নীতির কারণে আমরা এগুতে পারিনা। তারপরও দেশের প্রতি অঙ্গীকারের কারণে আমাদের কিছু করার মানসিকতা নিয়েই এগুতে হবে। তিনি প্রযুক্তি সেক্টরে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঝুঁকি এড়াতে বেপজার মত সরকারী প্রতিষ্ঠানকে বেছে নেয়ার জন্য প্রবাসীদের পরামর্শ দেন।
ভার্জিনিয়া টেক এর ইলেকট্রিক্যাল ও কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এবং দি ইন্সটিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ড. সাইফুর রহমান বলেন, শুধু সরকারের দিকে না তাকিয়ে আমাদের উদ্দেশ্য হলো বাইটপোর মত সংগঠনের মাধ্যমে নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করে অপরকে সুযোগ করে দেয়া। তিনি বলেন, কতিপয় সংখ্যক শিক্ষক আমেরিকায় বসে বাংলাদেশের বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে অনলাইনে শিক্ষা দিচ্ছেন। একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করে এই সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করা যেতে পারে। সর্বোপরি আমরা প্রত্যেকে পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেন একজন প্রবাসী হিসেবে আমরা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারি।
ভয়েজ অব আমেরিকা বাংলা বিভাগের প্রাক্তন প্রধান রোকেয়া হায়দার বলেন, আমাদের শেকড় বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠী আমাদের সম্পদ। এই সম্পদকে দক্ষ করে গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, পাশর্^বর্তী দেশের ন্যায় আমাদের দেশেও বিভিন্ন জায়গায় আইটি হাব গড়ে তুলতে দেশে শিক্ষার্থীদের আইটি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে।
নিউ জার্সির মনমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব সোস্যাল ওয়ার্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং আমেরিকান ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ এর প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ড. গোলাম এম মাদবর বলেন, বৈশ্বিক উন্নয়নে কতিপয় লোকের উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু সাধারণ জনগোষ্ঠী লাভবান হতে পারছেনা। আর্থিক প্রবৃদ্ধি হলেও সামাজিক সমস্যা বেড়েই চলেছে। আর তাই এই ব্যাপক জনগোষ্ঠী ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের উন্নয়নে তথ্য প্রযুক্তি, বায়োটেক, ফার্মা টেক, রিয়েল স্টেট, হেল্থ এন্ড এডুকেশন, ট্যুরিজমের মত ক্ষেত্রগুলোতে প্রবাসী বাংলাদেশীরা মনোযোগ দিতে পারে।
মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক এবং আমেরিকান এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশী ইঞ্জিনিয়ার্স এন্ড আর্কিটেক্ট (আবিয়ার) প্রেসিডেন্ট ড. ফয়সাল কাদের বলেন, বাংলাদেশে অনেক মেধাবী থাকলেও তাদের সুযোগের অভাব রয়েছে। আমাদের বৃহৎ এনটিটি ব্যবহার করে তাদের প্রশিক্ষণ দিতে পারি। আমাদের এনটিটি ব্যবহার করে আউট সোর্সিংয়ের ব্যবস্থা করতে পারি।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং দুর্ণীতিকে প্রধান সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে মেরিল্যান্ডের জন হপকিন্স বিশ^বিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি ও ইউএস এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সীর বিজ্ঞানী ড. মিজানুর রহমান বলেন, প্রথমেই আমাদের দুর্নীতি সমূলে দূর এবং শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করতে হবে যেখানে নৈতিকতা আর গণতন্ত্রের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে। তিনি সাইন্স ডিপ্লোমেসীকে প্রাতিষ্ঠনিক রূপদানের উপরও গুরুত্বারোপ করেন।
বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তা অ্যান্থনী পিউস গোমেজের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সেমিনারের অন্যান্যের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন বিশ্ব ব্যাংকের পরামর্শক ড. আনোয়ার করিম, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব ট্রান্সপোর্টেশন এর পিই ট্রান্সপোর্টেশন স্পেশালিস্ট প্রফেসর ড. নজরুল ইসলাম, ভার্জিনিয়ার জর্জ মেসন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি প্রফেসর ড. আমিনুর রহমান, মেরিল্যান্ডের মন্টগোমারী কলেজের বায়োলজি বিভাগের অ্যাডজাঙ্কট প্রফেসর ড. সোয়েব চৌধুরী, রেডিও টুডে’র ম্যানেজিং ডিরেক্টর রফিকুল হক, সাংবাদিক শাহিদ মোবাশে^র, বাইটপোর ভাইস প্রেসিডেন্ট ইউএস কাস্টমস এন্ড বর্ডার প্রোটেকশ এর সোলিউশন আর্কিটেক্ট আইটি বিশেষজ্ঞ সাইফুল্লাহ খালেদ, বাইটপোর পরিচালক ও ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটির সিনিয়র আইটি কনসালটেন্ট শ্যাম রিয়া প্রমুখ।
========================