লেখার আনন্দ, লেখকের আনন্দ
জসিম মল্লিক : ১. লেখকরা সবচেয়ে বেশি অবহেলিত আর নিগৃহিত হয় তার ফ্যামিলির কাছে। লেখালেখি আবার একটা কাজ হলো! গল্প, উপন্যাস লেখে অকম্মার ঢেকি যারা তারা। কিছু করার যোগ্যতা নাই তাই লেখক। অতি জঘন্য কাজ। মা, বাবা, ভাই বোন, স্ত্রী, সন্তান কেউই লেখালেখিকে আকড়ে থাকাকে সমর্থন করে না। তারা চায় লেখক না হয়ে ডাক্তার হোক, ইঞ্জিনিয়ার হোক, পাইলট হোক, পুলিশ হোক, আইনজীবি হোক, সরকারী কর্মকর্তা হোক, ব্যাংকার হোক, খেলোয়াড় হোক। নিদেনপক্ষে সরকারি অফিসের কেরানী হোক। পরিবারের কাছে লেখক সবচেয়ে উপেক্ষিত, গুরুত্বহীন মানুষ। লেখককে ভালবাসে শুধু পাঠক। তাই সব বাধা, বঞ্চনা আর অবহেলা উপেক্ষা করেও কেউ কেউ শুধু লেখকই হতে চায়! কিন্তু কেনো চায় এর উত্তর অজানা। একজন লেখকের সমস্ত অবহেলার জবাব হচ্ছে আরো বেশি লেখা। যত বেশি অবহেলা, ততবেশি লেখা। যত বেশি উপেক্ষা তত বেশি লিখে যাওয়া।
২.আমিও সব বাঁধা উপেক্ষা করে শুধু লেখক হতে চেয়েছি। সব প্রলোভন ভুলে একজন লেখকই হতে চেয়েছি। সমস্ত সুযোগ সুবিধা পায়ে দলে লেখার পিছনে ছুটেছি। সেজন্য আমাকেও কম নিগ্রহ সহ্য করতে হয়নি। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য পেয়েছি অনেক। শুধু ঘরেই না বাইরের পৃথিবীতেও লেখকের জন্য অনেক কন্টক বিছানো থাকে। লেখকও কখনও কখনও লেখকের শত্রু হয়ে উঠে। এই কঠিন পৃথিবীতে শুধু লেখক সত্ত্বা নিয়ে বেঁচে থাকা এতো সহজ কাজ না। আমার মতো পরিবারে যেখানে সাহিত্যের কোনো প্রচলন ছিল না সেই পরিবারের কারো লেখক হতে চাওয়া অবাক ঘটনাই বটে। আমি দিন রাত বই পড়তাম, চিঠি পত্র লিখতাম বলে আমি ছিলাম অনেকের চোখে বখে যাওয়া সন্তান।
৩.কিন্তু আমার মা আমার পক্ষে ছিলেন। মা লেখা পড়া জানতেন না ঠিকই কিন্তু আমার প্রতি সহানুভূতি ছিলেন। মায়ের একটাই ভয় ছিল বাপ মরা ছেলে লেখা পড়া না শিখলে খাবে কি! আমার প্রয়াত বোন সাজু আমি লিখি বলে খুব গর্ব অনুভব করত। সবাইকে ডেকে ডেকে বলত আমার ভাই জসিম লেখে। ছাত্র জীবনে টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে বা হল জীবনে কাপড় চোপর না কিনে সেই পয়সা দিয়ে, কখনও উপোস থেকে গল্পের বই কিনতাম, পত্রিকা কিনতাম। ১৯৮৬ সালে একবার সাজুর শশুড় বাড়ি গিয়েছি, সাজু বলল জসিম তুই এই শার্টটা পড়ে গত বছরও এসেছিলি। তোর আর শার্ট নাই! আমি বললাম, থাকবে না কেনো। আমার একই রকম অনেকগুলো শার্ট। সাজু আমাকে মাঝে মাঝেই টাকা দিত কাপড় কেনার জন্য। আমার দুই সন্তান অর্ক এবং অরিত্রি সবসময় আমার লেখক স্বত্ত্বাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। প্রাউড ফিল করে।
৪.গত ১৬ অক্টোবর আমার পুরস্কার প্রাপ্তিতে আনন্দ সন্ধ্যায় অরিত্রি এসেছিল। লাজুকভাবে পিছনের সীটে বসেছিল। অরিত্রিকে দেখে আমি এতোটাই আনন্দিত হয়েছি যে কথাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। লুৎফর রহমান রিটনও অনেক খুশী হয়েছিলেন। জেসমিন ঢাকায়, অর্ক ছিল কুইবেক তাই আসতে পারেনি। হঠাৎই এই আয়োজন। অরিত্রিকে আমি সামনের সীটে এনে বসালাম। অরিত্রি আমাকে কানে কানে বলল, বাবা টরন্টোবাসী মানে কি! আমি বুঝিয়ে বললাম। অরিত্রি মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে দুই তিন মিনিট কথা বলল। অরিত্রির আবেগ আমি টের পাচ্ছিলাম। উপস্থাপক শওগাত আলী সাগর বললেন, আমার মনে হলো অরিত্রি অনেক কিছুই বলতে চেয়েছিল, তার চোখে মুখে অনেক কথা ছিল।
আমার সন্তান, আমার কয়েকজন বন্ধু আর আমার পাঠকের অব্যাহত সমর্থন আর ভালবাসাই আমাকে লিখতে অনুপ্রানিত করে, শক্তি দেয়। লিখে আমি আনন্দ পাই।
টরন্টো ২০ অক্টোবর ২০২২