ধর্ম যার যার, উৎসব……..
ড. সৈয়দ ফজলে রউফ : (ডিসক্লেমারঃ কেবলমাত্র চিন্তাশীল হেলথি ম্যাচিওর ডিসকাশন ওয়েলকাম। গালিগালাজ, ফতোয়া, ধর্মবিরোধী বক্তব্য -কোনোটিই দেবার দরকার নেই ।ব্যবহারে বংশ ও ম্যাচিওরিটির পরিচয় । ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক বিষয়ে ডিসকাশন পছন্দ না হলে পোস্টটি এড়িয়ে যান, ধন্যবাদ )
যেকোনো কম্যুনিটির সেলিব্রেশনে থিম-লাইট-মিউজিক-কালার-ফ্যাশন-ফুড এই ব্যাপারগুলো মোটামুটি কমন । এই ফ্যাক্টরগুলো যতবেশি থাকবে সেলিব্রেশন ততবড় বা ব্যাপকতা বা পপুলারিটি পাবে । যদি আপনি যেকোনো ইভেন্ট আয়োজন করেন বা নিদেনপক্ষে জয়েন করেন যেমন অফিসে ফ্যামিলি ডে, শহরের সামার বা উইন্টার ফেস্টিভল বা স্কুল/কলেজ/ইউনিভার্সিটি’র রিইউনিয়ন পার্টি, ব্যান্ডের কনসার্ট- খেয়াল করে দেখবেন যেকোন এই উপাদানগুলো যতবেশি থাকবে ইভেন্ট তত জমজমাট এবং স্মরনীয় থাকবে । পপুলার এথনিক, ন্যাশনাল বা রিলিজিয়াস ফেস্টিভলগুলো লক্ষ্য করলেও আপনি এই জিনিসগুলোর আধিক্য পাবেন । যেমন নিউইয়ার, স্প্রীং ফেস্টিভল, নওরোজ, দিওয়ালী, চাইনিজ নিউইয়ার, সেইন্ট প্যাট্রিকস ডে, অক্টোবর ফেস্ট, হ্যালোউইন – ইউ নেইম ইট। সেই কারনেই হয়ত এসব লোকালাইজ অথবা ধর্মীয় ইভেন্ট পাবলিক এট্রাকশন বা পপুলারিটি পেতে বেশি সময় লাগেনা ।
মুসলিমদের ধর্মীয় ইভেন্ট মূলতঃ দুই ঈদ । সারা বিশ্বে কি অবস্হা জানিনা – ক্যানাডায় মুসলিম কম্যুনিটি পাবলিকলি ঈদ কতটুকু জাকজমকভাবে সেলিব্রেট করে সেটা প্রশ্নবোধক। যেমন ধরেন উইক ডেজ হোক বা উইকেন্ড-ক্যানাডায় বড় শহরগুলোতে সনাতন ও শিখ ধর্মালম্বীরা দিওয়ালী মোটামুটিভাবে পাবলিকলি সেলিব্রেট করে । দিওয়ালির লাইটিং ও বাজি ফুটানো একটা পাবলিক ইভেন্ট যেটা যে ধর্ম বা দেশের লোক হোক না কেন তাকে এই ইভেন্টটা এট্রাক্ট করবে – আফটার অল বাজি ফুটানো জিনিসটা সারাবিশ্বের মানুষকেই এট্রাক্ট করবে । একই ব্যাপারটা চাইনিজ নিঊইয়ার উপলক্ষেও দেখা যায়। গত ৬ বছরে কানাডা‘য় ৩ টি ডিফারেন্ট নামকরা কম্পানিতে কাজের জায়গায় চাইনিজ নিঊইয়ার উপলক্ষে লাল খামে চকলেট বা গুডিব্যাগ গিফ্ট পেয়েছি যেটা হ্যালোইন উপলক্ষেও পেয়েছি ।এর বিপরীতে বাঙালী মুসলমানদের ঈদ ইভেন্টের পাবলিক এট্রাকশন ফ্যাক্টরটা কি ? ঈদ আসলে আপনি মুসলিমদের বাসার সামনে রাস্তায় অনেক গাড়ি পার্ক করা দেখবেন, বাসায় দাওয়াতে ফ্যাশন আর ফুড দেখবেন, হয়ত দুয়েকটি বাসার বাইরে ছোটখাটো স্কেলে লাইটিং দেখবেন- দ্যাটস অল- নিজেদের কম্যুনিটি কেন্দ্রিক সেলিব্রেশন মাত্র। কোনো ননমুসলিম পাবলিক এনগেজিং সেলিব্রেশন ইভেন্ট দেখবেন কি- যেটাতে নেইবরহুডের অন্য দেশের মানুষও পার্টিসিপেট করতে ইন্টারেস্টেড ফিল করে বা এনগেজ করার ফ্যাক্টর থাকে ?
ইসলাম ধর্মের ফিলোসফিক্যাল থিম ; আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন- সিম্পল এন্ড ক্লিয়ার । পার্থিব জীবন মূলতঃ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের টেস্টিং পিরিয়ড – সমস্ত পার্থিব কার্যকলাপের মূল লক্ষ্য অনন্ত পারলৌকিক জগতের প্রাপ্তি । ইসলামের সেলিব্রেশন থিমও মূলতঃ আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রাপ্তি। কিন্তু এই সেলিব্রেশনের রিলিজিয়াস কম্পোনেন্ট গুলো বাদ দিয়ে সোস্যাল বা কালচারাল ইভেন্টগুলো কি কেবল মুসলিমদের জন্য নির্দিষ্ট, নাকি সবার জন্যে উন্মুক্ত ? ইসলাম ধর্মীয় বিশ্বাস তাকে অন্য ধর্মীয় ইভেন্টে অক্টিভ পার্টিসিপেশনে বার দেয়- মোস্ট ইমপরটেন্ট পয়েন্ট । কিন্তু এই ব্যারিকেডের সীমানা কতটুকু ? আপনি (মুসলিম) ক্রিসমাসে চার্চে যান না, হোয়াট অবাউট ক্রিসমাস ডিনার, ক্রিসমাস সেল এমনকি ক্রিসমাস লাইটিং দেখতে যাওয়া ? – অথবা ইস্টার সেল-এসব কিছুর যে মূল থিম যিশুখ্রীস্টের জন্ম ও মৃত্যুদিন যা ইসলামের বয়ানের সাথে অসঙ্গতিপূর্ন -সেটাতে আপনার পার্টিসিপেশনের মাত্রা কতটুকু ? নেইবারহুডে রানী ভিক্টোরিয়ার জন্মদিন বা দিওয়ালী উপলক্ষে বাজিফোটানো ? হ্যালোইন বা ক্রিসমাস উপলক্ষে বিভিন্ন নেইবারহুডে ডেকোরেশন বা লাইটিং দেখতে ড্রাইভথ্রু করা ? কোন জায়গায় বাঙালী মুসলমানরা এই ফাইন লাইনটা টানেন, যে দাগের ওইপাশে আর যাওয়া যাবেনা?
যেকোনো কসমোপলিটন এক একটা মেলটিং পট- সোজা কথায় বাজারের মতো; ভাষার বাজার, ভাবের বাজার, ধর্মের বাজার, কালচারাল বাজার, প্রডাক্টের বাজার। আপনি আপনার জিনিস নিয়ে আসবেন, আমি আমার জিনিস নিয়ে আসবো, অমুক তার জিনিস আনবে, তমুক তার জিনিস আনবে । পন্যের মান, মোড়ক, দাম সবকিছুর ওপরেই নির্ভর করবে পন্য চলবে কিনা, অন্যজন ইন্টারেস্টেড হবে কিনা, পপুলার হবে কিনা। যেমন ধরেন জাপানি গাড়ির থিম হচ্ছে রিয়ালেবিলিটি, জার্মান গাড়ির এলিগেন্স, আমেরিকান গাড়ির সস্তা দাম – বাজারে আপনার চাহিদা ও সামর্থ্য অনুযায়ী গাড়ি কিনবেন । আপনার ক্রয় ক্ষমতা কম আপনি ফোর্ড কিনবেন, কিন্তু আপনি যদি ফোর্ডের গাড়িতে টয়োটার রিলায়বিলিটি আশা করেন সেটা আপনার ভুল। আবার আপনি টয়োটা কিনে সেখানে মার্সিডিজের এলিগ্যান্স আশা করবেন না নিশ্চয়ই ।
কসমোপলিটন মুসলিমদের সেলিব্রেশন নিয়ে ওভারঅল ভাববার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি। ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ কূয়া‘ থেকে লাফ দিয়ে বেড়িয়ে আসা কসমোপলিটন বাঙালি মুসলমানদের – যারা অনবরত অপসংস্কৃতি-বেদাত নিয়ে অতিশয় চিন্তিত তাদের জন্য এটা আরো বেশী প্রয়োজন বলে আমার ব্যক্তিগত মতামত। এই সোকল্ড ফার্স্টওয়ার্ল্ড মুসলিম প্রবলেম-কোনো নতুন বিশ্বের নতুন ইস্যু নিশ্চয়ই নয়- কারন মুসলিমরা বহু আগেই কসমোপলিটান এ্যটিটিউট সম্পর্কে ওয়াকিবহাল । আবসিনিয়া, পারস্য, স্পেন, উজবেকিস্তান, ভারত, জেরুজালেমে – মুসলিমদের কসমোপলিটন পরিবেশের সাথে পরিচয় ঘটেছে | বাগদাদ, দিল্লি বা ইস্তান্বুলের মতো মুসলিম কসমোপলিটনের অতীত উদাহরণ নিশ্চয়ই এসব বিষয় নিয়ে ভাবতে সাহায্য করতে পারে ।
একই সাথে কসমোপলিটান বাঙালি ও মুসলিম হিসাবে আপনি মেলটিং পটের ভেতরে থেকে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে চাইতেই পারেন- নো প্রব্লেম । আপনি বাজারে গিয়ে অন্যের প্রডাক্ট কিনবেননা -গুড, আবার নিজের প্রডাক্টও অন্যের জন্য আকর্ষনীয় করবেননা – ভেরি গুড । কিন্তু ওভারঅল ক্রমে ক্রমে বাজারে আপনি লোকালাইজ্ড, আইসোলেটেড, সিলেকটিভ ক্রেতার দোকানে পরিনত হবার রিস্কে পরে যেতে পারেন যেটার ধারনাটাও হয়ত মাথায় রাখাটা দরকারী।
প্রতি বছর দেশে বিদেশে বিভিন্ন অবাঙালি অথবা ননমুসলিম ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইভেন্টগুলো আসলেই মুসলিম বাঙালিদের ‘জাত গেল, ধর্ম গেলো’- কনসার্ন দেখা যায়- যেটা ভ্যালিড এবং রেশনাল । কিন্তু বহুবছরের এই ভ্যালিড ও রেশনাল কনসার্নের বিপরীতে ভ্যালিড কোনো কাউন্টার আইডিয়া বা ইভেন্ট একেবারেই অনুপস্থিত ।কসমোপলিটান মুসলিম বাচ্চা ও ইয়াং ক্রাউডের গ্লোবাল সেলিব্রেশন কি বা কোনটা যেটাতে অন্য একটা ননমুসলিম বাচ্চা পার্টিসিপেট করবে বা এটলিস্ট ইন্টারেস্টেড হবে ? জন্মদিন, হ্যালোইন, দিওয়ালী, চাইনিজ নিউইয়ার, হানুককাহ উপলক্ষে স্কুলের বাচ্চার টিচার বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাচ্চার প্যারেন্টসরাও ক্লাসের অন্য বাচ্চাদের তাদের সেলিব্রেশনের থিম বেস্ড গিফ্ট বা গুডি ব্যাগ দিয়ে থাকে ।হাজার বছরের ঐতিহ্যের সালাফি হুজুর বাঙালি মুসলিমদের কাছে সবই বিজাতীয় জাতগেলধর্মগেল সাংস্কৃতিক আগ্রাসন । ঈদ উপলক্ষে কি বছরে একবার ক্লাসের অন্য বাচ্চাদের গুডি ব্যাগ বা ছোট গিফ্ট ব্যাগ দেওয়াও কি ‘ফালতু টাকাপয়সার অপচয়কারী শয়তানের ভাই ?’ । মেল্টিং পটে ক্লাসের অন্য বাচ্চাদের মাঝে মুসলিম বাচ্চাটার সেলিব্রেশনের ইভেন্টটা আসলে কি? উইকেন্ডে দাওয়াত খাওয়া ?
ভারতের কসমোপলিটান মুসলিমদের একটা কাউন্টার সেলিব্রেশন ইভেন্ট ছিল শবেবরাতের হালুয়া-রুটি,পটকাবাজি -যেটাতে রিলিজিয়াস কম্পোনেন্ট থেকে কম্যুনিটি ফেস্টিভ কম্পনেন্ট ছিল বেশি। সালাফি হুজুররা এসে বিদাত-বেশরিয়তের লজিক তুলে পুরো ইভেন্টটা একেবারেই নাই করে ফেললো। অথচ ইনোভেটিভ হয়ে বেদাতি রিলিজিয়াস কম্পোনেন্টটাকে বাদ দিয়ে কালচারাল কম্পনেন্টটা এনহ্যান্স করে এটাকে ভারতবর্ষের মুসলিমদের শুরু করা হালুয়া-রুটি-পটকাবাজির একটা ফেস্টিভল করা যেত । কিন্তু ওইযে……ধর্ম যার যার উৎসব তার তার।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতি ও ধর্মের একমাত্র ধারক ও বাহক বাঙালি মুসলমানেরা ‘হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী কূয়া‘ থেকে লাফ মেরে কেন লিবারেল কসমোপলিটন মেল্টিং পটগুলোতে এসে পরেন ? কেনো তারা এরকম একটা চ্যালেন্জিং সেকেন্ড হোম খুঁজে নেন যেখানে তারা এডাপ্টিভ হবেননা আবার কাউন্টার প্রোডাক্টিভ কোনো কিছুর করার মতো ইনোভেটিভও হবেননা ? কেনো তারা এন্ড অফ দা ডে ন্যাগিং ন্যান্সি হবেন, বাঙালী-সালাফি হুজুর হবেন ?
- লেখকের ফেসবুক পোষ্ট