ঋষি সুনাক ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী
শিতাংশু গুহ : আলোর উৎসব ‘দিওয়ালি’-র মাহেন্দ্রক্ষণে একদা ‘সূর্য অস্ত না যাওয়া’ বৃটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী লন্ডনে সোমবার ২৪শে অক্টোবর একজন ভারতীয় বংশোদ্ভুত প্র্যাক্টিসিং হিন্দু ঋষি সুনাক-র নাম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ঘোষিত হবার সাথে সাথে দিকে দিকে আনন্দোৎসব শুরু হয়ে যায়। পুরো ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ, বিশেষত: হিন্দু সম্প্রদায় খুশিতে আপ্লুত হয়। প্রায় একই সময়ে ভারতীয় ক্রিকেট দল পাকিস্তানকে পরাজিত করে এবং নিউইয়র্ক সিটি স্কুলে ‘দিওয়ালি’ ছুটি ঘোষিত হয়। এ বছর হোয়াইট হাউসে সাড়ম্বরে ‘দিওয়ালি’ উৎসব পালিত হয়। ১০নং ডাউনিং ষ্ট্রীট, অর্থাৎ বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী আবাসস্থলে ‘দিওয়ালি’ তাৎপর্যময় ছিলো তা বলা বাহুল্য। লন্ডনের মেয়র সাদিক খাঁন এবং নিউইয়র্ক মেয়র এরিক এডামস ঘটা করে ‘দিওয়ালি’ পালন করে।
শুক্রবার ২৮শে অক্টোবর ঋষি সুনাক আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নেবেন। তিনি প্রথম অশ্বেতাঙ্গ, প্রথম এশীয়/ভারতীয় বংশোদ্ভুত, প্রথম হিন্দু এবং বৃটেনের ২শ’ বছরের ইতিহাসে সর্ব-কনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী। ১২ই মে ১৯৮০ ব্রিটেনের ইয়র্কশায়ারে ঋষি সুনাকের জন্ম, বয়স মাত্র ৪২। প্রকৃতি’র কি সুমধুর প্রতিশোধ, যে বৃটিশরা ২শ’ বছর ভারত শাসন করেছে, মাত্র ৭৫ বছরের ব্যবধানে একজন ভারতীয় বংশোদ্ভুত বৃটেন শাসন করবেন। সুনাক কনজারভেটিভ টোরি পার্টির প্রধান, একদা কিংবদন্তি উইনস্টন চার্চিল এর প্রধান ছিলেন। ঋষি সুনাকের ভাষায়: “আমি আগাগোড়া বৃটিশ, গ্রেট বৃটেন আমার দেশ, বাড়ী। তবে আমার ধর্ম ও সংস্কৃতির শিকড় ভারতীয়। আমার স্ত্রী ভারতীয়। আমি খোলাখুলিভাবে হিন্দু”।
সুনাক পত্নী ‘অক্ষতা’ ইনফোসিস কর্ণধার বিলোনিয়ার ‘নারায়ণ মুরতি’-র কন্যা, যাঁকে ভারতে ‘বিল গেট্স’ বলা হয়। সুনাক-অক্ষতার পরিচয় যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যান্ডফোর্ডে, প্রথমে প্রেম, তারপর বিয়ে আগষ্ট ২০০৯, তাঁদের দুই কন্যা, কৃষ্ণা ও অনুষ্কা। ইয়র্কশায়ারের এমপি সুনাক শপথ নিয়েছিলেন ‘ভগবত গীতা’ হাতে, অনেকের ধারণা গীতা হাতেই তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেবেন। শুনাক দম্পত্তি ৭শ’ মিলিয়ন পাউন্ডের মালিক, যা বৃটেনের রাজা ৩য় চার্লসের সম্পদের দ্বিগুন। সুনকের শ্বশুরবাড়ী ব্যাঙ্গালোর, সেই সূত্রে প্রায়শ: তিনি ভারত সফর করেন। ইয়র্কশায়ারে তাঁর বিলাসবহুল বিশাল প্রাসাদ, দামী স্যুট, জুতার জন্যে তিনি সমালোচিত হ’ন। প্রায়শ: তিনি বলে থাকেন, ‘গীতা আমাকে বিপদে-আপদে রক্ষা করে’। এই দম্পতি’র নামে সেন্ট্রাল লন্ডনের কেনসিংটনে সম্পত্তি রয়েছে। শরীর ঠিক রাখতে তিনি নিয়মিত ক্রিকেট খেলেন।
ঋষি সুনাক-র পিতামহের্ বাস ছিলো পাকিস্তানের গুজরানওয়ালা। সেদিক থেকে পাকিস্তানীরা খুশি, এবং সুন্ক পাকিস্তানী বংশোদ্ভুত বলে দাবি করছেন। সুনকের বাবা যশবীর কেনিয়ার, পেশায় ডাক্তার ছিলেন, মা তাঞ্জানিয়ার, পেশায় ফার্মাসিষ্ট। ৬০’র দশকে তাঁরা বৃটেনে পাড়ি জমান। তাঁর ঠাকুরদা পাঞ্জাব থেকে আফ্রিকায় আবাস গড়েন। সুনাক বিখ্যাত অক্সফোর্ডের স্নাতক। এমবিএ করেন ষ্ট্যানফোর্ড থেকে। পত্নী অক্ষতা সাউথ ইন্ডিয়ান, তিনিও কম আলোচিত নন, অক্ষতার মা সুধা মূর্তি টাটা মোটরসের প্রথম নারী প্রকৌশলী। স্ট্যান্ডফোর্ডে প্রণয় থেকে পরিণয় সুনাক-অক্ষতার। ৪২ বছর বয়সী অক্ষতা পেশায় ফ্যাশন ডিজাইনার। ২০১০ সালে নিজের ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘অক্ষতা ডিজাইন্স’ গড়ে তোলেন। সানডে টাইমসের শীর্ষ ধনীর তালিকায় তাঁর নাম আছে। প্রয়াত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সম্পদের থেকেও তাঁর সম্পদ বেশি। রানীর ছিল প্রায় ৪৬ কোটি ডলার। অক্ষতার শুধু ইনফোসিসেই আছে ১০০ কোটি ডলার মূল্যমানের শেয়ার। বিবিসি অক্ষতাকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
মঙ্গলবার ২৫শে অক্টোবর ঋষি সুনাক বাকিংহাম প্যালেসে বৃটেনের রাজা ৩য় চার্লসের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এরআগে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস রাজার কাছে পদত্যাগ পত্র জমা দেন্। গত পৌনে দুই মাসে বৃটেনে তিনজন প্রধানমন্ত্রী বদল হয়, বরিস জনসনের পর লিজ ট্রাস মাত্র ৪৪দিন ক্ষমতায় ছিলেন। লিজ ট্রাসের পদত্যাগের পরপরই বরিস জনসন তাঁর প্রার্থিতা ঘোষণা করেন। বিরোধী লেবার পার্টির পুন্:নির্বাচনের দাবি জোরদার হতে থাকে। জাতীয় নির্বাচনের এখনো দুই বছর বাকি, টোরি পার্টি অসময়ে ক্ষমতা হারাতে রাজি নয়। ফলে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা সত্বেও বরিস সরে দাঁড়ান। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘ এসময়ে অভ্যন্তরীণ ফাইট ঠিক হবেনা। ২০২৪ সালে নির্বাচনে জয় আনতে আমি প্রস্তুত। পার্লামেন্টে দলকে সুসংহত রাখতে হবে’। বরিস সরে দাঁড়ালে সুনাকের কপাল খুলে যায়, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ-নেতা নির্বাচিত হ’ন। গ্রাসরুট পর্যন্ত ভোট হলে বরিস’র জয় ঠেকানো যেতো না? ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বরিস জনসন সরকারের অর্থমন্ত্রী হন সুনাক। এর পর থেকে দেশটির রাজনীতিতে বেশ আলোচনায় আসে তার নাম। বৃটেনে মাত্র ১.৫ শতাংশ হিন্দু। ভারতীয় ২.৩%। সুনাক কতটা সফল হবেন তা ভবিষ্যৎ জ্ঞাতব্য। তিনি অর্থমন্ত্রী ছিলেন। বরিস জনসন প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে, বিশেষত: অসুস্থতার সময় ঋষি সুনাক রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। তিনি সফল ইনভেষ্টমেন্ট ব্যাঙ্কার। বৃটেনে এ সময়ে অর্থনৈতিক টালমাটাল অবস্থা চলছে, সুনাক হয়তো সঠিক ব্যক্তিত্ব, যিনি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।
ঈশ্বর সুনাক-কে ছপ্পর ছেঁড়ে দিয়েছেন। একেই বলে কপাল। এক জার্মান ইয়ং মহিলা নাকি ৬০’র দশকে দিল্লিতে এসে একটি ট্যাক্সি ক’দিনের জন্যে ভাড়া করেন। ড্রাইভারের নাম ছিলো গোপাল। কিছুদিন চলাফেরার পর মহিলা ড্রাইভারের প্রেমে পড়েন এবং তাঁকে বিয়ে করে জার্মানী নিয়ে যান। এরপর থেকেই লোকে বলে, ‘কপালের নাম গোপাল’। তবে সুনাকের যাত্রাপথ কুসুমাস্তীর্ণ হবেনা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং ঋষি সুনাকের রাজনৈতিক উত্থান অনেকটা একই রকমের হলেও মসৃন ছিলোনা, ওবামা সফল হয়েছেন, সুনাক কি টিকে থাকতে পারবেন? রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে পুরো বিশ্ব তটস্থ। অর্থনীতি বিপর্যস্ত। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ঋষি সুনাক-কে যুদ্ধ বন্ধে উদ্যোগী হতে হবে। ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধে ১০নং ডাউনিং ষ্ট্রীট উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলো, সুনাক কি পারবেন, যুদ্ধ থামাতে বা উত্তেজনা কমাতে? সুনাক কি পারবেন একহাতে হোয়াইট হাউস, অন্যহাতে ক্রেমলিন সামলাতে? কমলা হ্যারিস বা নরেন্দ্র মোদিকে কি সাথে পাবেন? সবাইকে ‘দিওয়ালি’র শুভেচ্ছা। guhasb@gmail.com