১০ই ডিসেম্বর কিচ্ছু হবেনা
শিতাংশু গুহ: ১০ই ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। আমেরিকা গতবছর ২০২১-র এদিনে ৱ্যাব-এর ক’জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারী করেছিলো, তা বহাল আছে। ২০২২’র ১০ই ডিসেম্বর বিএনপি ঢাকায় ‘মহাসমাবেশ’ ডেকেছে। সবাই ভাবছে, কি হবে সেদিন? এদিকে রিজার্ভ নিয়ে বক্তব্য, পাল্টা-বক্তব্য, গুজব থামছে না। মানুষ কার কথা বিশ্বাস করবে? মিডিয়ায় নিউজ ‘ইসলামী ব্যাঙ্কও খাওয়া হয়ে গেছে’। নিউইয়র্কে সোনালী ব্যাঙ্কের এমডি বলেছেন, দু:চিন্তার কোন কারণ নেই, সবকিছু ঠিকঠাক আছে। অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ডঃ আবুল বারাকাত বলেছেন, ২০২৭ সাল থেকে পাঁচটি বড় প্রকল্পে ঋণ পরিশোধ শুরু হবে, ততদিন কি রিজার্ভ থাকবে? দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনগণের নাভিশ্বাস উঠে গেছে, দুর্ভিক্ষের কথা উচ্চারিত হচ্ছে, সাধারণ মানুষ কি করবে?
প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর বাতিল হয়েছে। এরআগে জাপানী রাষ্ট্রদূতের কথায় বোঝা যায়, জাপান সব দলকে নিয়ে অবাধ, সুষ্ঠূ নির্বাচন চায়। প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বললেও এটি স্পষ্ট যে, পররাষ্ট্র দফতর জাপানী রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এনে কোন কথা বলেনি। জাতিসংঘ, মার্কিন কর্মকর্তাদের কথাবার্তা সরকার যেভাবে চাইছেন, ঠিক তেমনটি নয়! সাধারণ জনগণ বুঝতে চাচ্ছেন, চারিদিকে কি হচ্ছে? এরমধ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ২০০১-এ আওয়ামী লীগকে জোর করে হারানো হয়েছিলো। কথাটা সত্য, এবারো যে তা হচ্ছেনা, এই গ্যারান্টি কোথায়? দল হিসাবে আওয়ামী লীগের জনসমর্থন অনেক কমে গেছে, সেটি অস্বীকার করে কোন লাভ নেই! দেশে তো বিএনপি-জামাত ছিলোনা, হটাৎ করে এদের সমর্থন বেড়ে গেলো কিভাবে?
বিএনপি’র উত্থানের পেছনে শক্তিটি কি বা কে? শক্তি বিএনপি’র বেড়েছে কিনা জানিনা, তবে এন্টি-আওয়ামী লীগার বাড়বাড়ন্ত। বিএনপি এর সুযোগ নিচ্ছে। আওয়ামী লীগে যেমন শেখ হাসিনা ছাড়া কেউ নেই, বিএনপি-তে তেমনি বেগম জিয়া ছাড়া কেউ নেই? ১০ তারিখ কি বিএনপি বেগম জিয়াকে ছিনিয়ে নেবে? এত সাহস বিএনপি’র বর্তমান নেতৃত্বের নেই, কারণ এদের অনেকেরই গাঁটছড়া সরকারের সাথে বাঁধা। মাইনাস খালেদা জিয়া বিএনপি জিরো, যেকোন অবস্থায় তারেক রহমান দেশে ফিরতে পারবেন না? মিটিং-এ উপস্থিত আম-জনতা দেশ চালায় না, বিএনপি’র আগের নেতারা পরিত্যক্ত, তাদের দিয়ে কিচ্ছু হবেনা। নুতন নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়নি। বিএনপি হয়তো তা বুঝে, তাই শোনা যায়, তাঁরা অন্যদের সাথে মোর্চা করবেন, এবং আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
আওয়ামী লীগের অবস্থা তথৈবচ, মাইনাস শেখ হাসিনা সেখানে কেউ নেই, নুতন নেতৃত্ব প্রায় সবাই সুবিধাভোগী, অর্থবিত্ত বাঁচাতে তারা ব্যস্ত থাকবেন। পুলিশ প্রটেকশন ছাড়া আওয়ামী লীগের কর্মীদের রাস্তায় টিকে থাকা কষ্টকর হবে। এ মুহূর্তে সরকারের শক্তি, বা গত প্রায় ৬/৭ বছর সরকারের শক্তি হচ্ছে, পুলিশ ও প্রশাসন, এবং পরোক্ষভাবে সেনাবাহিনী। আন্দোলন তীব্রতর হলে, জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়লে পুলিশ, সেনা বা প্রশাসন নিমিষে পক্ষ ত্যাগ করতে দ্বিধা করবে না, কারণ তারাও জানে, দিনশেষে জনগণই সবকিছুর মালিক, সরকারের পক্ষ ত্যাগ করে তাঁরা জনগণের পক্ষে চলে আসবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর যথেষ্ট প্রমান তো আছেই। বোঝা যায়, ১০ই ডিসেম্বর কি করবে এনিয়ে বিএনপি দোটানায় আছে, ‘শ্যাম রাখি না, কুল রাখি’ অবস্থায়। একদিকে ক্ষমতার হাতছানি, অন্যদিকে–.।
বিএনপি’র দাবিনামার অন্যতম হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, ইলেকশন কমিশন নুতন করে সাজানো, কিছু প্রশাসনিক রদবদল, বেগম জিয়ার মুক্তি, ইভিএম বাতিল ইত্যাদি। তর্কের খাতিরে ধরে নেয়া যাক যে, শেখ হাসিনা’র সরকার সব দাবি মেনে নিলেন। বিএনপি তখন কি করবে? ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে খালেদা জিয়া খুব একটা কিছু করতে পারবেন না? কিন্তু এতে আওয়ামী লীগ আরো দুই বছর ক্ষমতায় থাকার সুযোগ পাবে, দল গুছাতে পারবে, জনমত পক্ষে টানার সুযোগ পাবে, তারপর নির্বাচনে যা হয় হবে? মনে রাখা দরকার, টোরি পার্টি আরো দু’বছর ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে ঋষি সুনাকের কপাল খুলেছে। যশোর জনসভায় ব্যাপক জনসমাগম ঘটেছে, শেখ হাসিনা দল গুচ্ছাছেন, তিনি জানেন ‘কত ধানে কত চাল’। তবে তাকে ঘরে-বাইরে চাপ সামলাতে হচ্ছে।
অবস্থা খুব একটা সুবিধার নয়। জনগণের আর্থিক সক্ষমতা কমে গেলো, দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে, ব্যাংকগুলোর প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে না পারলে, লোডশেডিং কমানো, বা রিজার্ভ বাড়ানো, রফতানি বাড়ানো না গেলে সমস্যা বাড়বে বৈকি। আর দুর্নীতি চলতে থাকলে কিছুই হবেনা, কিন্তু দুর্নীতি কমানোর কোন চাবিকাঠি সরকারের কাছে আছে বলে মনে হয়না। সরকার এক্ষুনি খানিকটা দুর্বল, জনগণের অসন্তুষ্টি, টাকা-পয়সা টানাটানি, এসবের সুযোগ নিতে হলে বিএনপি’র থাকতে হবে শক্তিশালী-শক্ত সাংগঠনিক কাঠামো, চৌকষ নেতৃত্ব, যার কোনটাই তাদের নেই? হয়তো একারণেই টরন্টো নিবাসী ড: তাজ হাশমী এখন প্রকাশ্যে জানাচ্ছেন যে, তাঁরা সরকারের পতনের লক্ষ্যে ১১ সদস্যের রিভলিউশনারি কমান্ড কাউন্সিল (আরসিসি) গঠন করেছেন। এই তারা কারা তা তিনি প্রকাশ করেননি, তবে নিজেকে ‘আহবায়ক’ হিসাবে পরিচয় দিচ্ছেন। মনে হচ্ছে তিনি ইরানের খোমেনীর মত বিদেশ থেকে গিয়ে বাংলাদেশে ক্ষমতা দখল করবেন?
স্বপ্ন দেখা ভালো। স্বপ্ন দেখতে পয়সা লাগেনা। সবাই ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখলে কি এমন ক্ষতি? হেফাজত ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলো, ওঁরা হারিয়ে গেছে। বিজ্ঞান বলে, কিছুই হারায় না, অবস্থার পরিবর্তন ঘটে মাত্র। জামাত-হেফাজত বা এন্টি-আওয়ামী লীগের সবাই এখন বিএনপি হয়ে যাবে। শেখ হাসিনা ‘দুধকলা’ দিয়ে সাপ পুষলেও’ এখন সুযোগ পেলে ওঁরা ছোবল মারবে। আওয়ামী লীগ আমলে দৃশ্যমান উন্নতি ঘটলেও ‘অবকাঠামোগত’ উন্নতি হয়নি, তাই এক্ষুনি এই অর্থনৈতিক টানাপোড়ন। এর আর একটি কারণ হচ্ছে, নৈতিক অবক্ষয়। ঢাকা থেকে দেশের যেকোন প্রান্তে যাতায়াতের সময় এখন কমে গেছে, সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবিক মূল্যবোধ, পরমত সহিষ্ণুতা, নৈতিক অবক্ষয় আরো অনেক বেশি কমে গেছে এবং এটি ঘটেছে আওয়ামী লীগের পৃষ্টপোষকতায়, ১৪বছর ক্ষমতায় থাকাকালীন। এর দায় কে নেবে? দেশের সামনে আরো সংকট ঘনীভূত হচ্ছে, জনগণ বিপদগ্রস্থ হোক তা কেউ চায়না। তবে যত গর্জে, তত বর্ষে না, ১০ই ডিসেম্বর কিচ্ছু হবেনা।
guhasb@gmail.com;