আপনার অনন্তযাত্রা শান্তিময় হোক তোয়াব ভাই
লুৎফর রহমান রিটন : নক্ষত্রপ্রতিম সাংবাদিক-সম্পাদক তোয়াব খানের প্রয়াণের সংবাদ দিয়েই শুরু হলো আমার আজকের দিনটি। আমার জীবনে তিনি ছিলেন মাথার ওপরে ছায়া হয়ে। কোনোদিন কাজ করা হয়নি তাঁর সঙ্গে কিন্তু তারপরেও আমাদের সম্পর্কটা ছিলো সহযোদ্ধার মতো। আমি আমার এক জীবনে পাওয়া সুহৃদদের তালিকার শীর্ষে থাকা অন্যতম নামটা ছিলো তোয়াব খানের। আমার প্রতি তাঁর মমতা বা ভালোবাসা বা স্নেহটা ছিলো শর্তহীন। আজ তাঁর প্রয়াণের মাধ্যমে আমি আরেকবার স্বজনহীন হবার বেদনায় বিপন্ন ও বিষণ্ণ।
অমৃতলোকে শান্তিতে থাকুন প্রিয় তোয়াব ভাই।
কয়েক বছর আগে কিংবদন্তি সাংবাদিক তোয়াব খানের জন্মদিন উপলক্ষ্যে একটি শুভেচ্ছা স্মারক আমি রচনা করেছিলাম ফেসবুকে।
আজ তাঁর প্রয়াণ দিনে সেই লেখাটাই ফের এখানে তুলে ধরছি আমার শ্রদ্ধার অর্ঘ্য হিশেবে।—
তোয়াব ভাইকে না বলা কুড়ি বছর আগের সেই ঘটনাটা
লুৎফর রহমান রিটন
জীবন আমার সংগ্রাম মুখর। একজন লেখক হিশেবে, একজন সামাজিক মানুষ হিশেবে, একজন সাধারণ নাগরিক হিশেবে, একজন রাজনীতি ও অধিকার সচেতন ব্যক্তি হিশেবে টিকে থাকার লড়াইটা আমাকে করতে হয়েছে অধিকাংশ সময়েই একলা একা। সেই দুঃসময়ে প্রায়শঃ একজন সজ্জন মেধাবী সাংবাদিক-সম্পাদক নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। যুগিয়েছেন বিপুল সাহস। প্রসারিত করেছেন সহযোগিতার হাত। সেই মানুষটা তোয়াব খান। আমাদের সাংবাদিকতার আকাশে নক্ষত্রপ্রতিম অনন্য ব্যক্তিত্ব তোয়াব খান। স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের কলমসৈনিক, আমার প্রিয় তোয়াব ভাই।
প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ছড়াবান্ধবহীন পরিবেশে ছড়াকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতেও অনেক লড়াই করতে হয়েছে আমাকে। সইতে হয়েছে অনেক অবজ্ঞা-অপমান। আড়ালে আবডালে বাংলাদেশের হাতেগোণা ক’জন বিখ্যাত পণ্ডিত-লেখক-কবি তাদের নির্লজ্জ হাস্য-তামাশার বিষাক্ত তীর আমার দিকে ছুঁড়েছেন। তাদের নিষ্ঠুরতা আমাকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। আমি তাদের প্রতি আমার ‘দাঁত-ভাঙা’ জবাব দিয়েছি অবিরাম এবং ক্রমাগত লিখে লিখে এবং লিখে। দীর্ঘ লড়াইয়ের এক পর্যায়ে ওরা অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন যে আমি একা নই, আমার সঙ্গে পাঠক আছেন, এবং সংখ্যায় তাঁরা বিপুল। পাঠকদের ভালোবাসাই আমাকে প্রেরণা যুগিয়েছে টিকে থাকার সংগ্রামে। তবে এটাও সত্যি যে, বাংলাদেশের অগ্রগণ্য প্রগতিশীল এবং লব্ধপ্রতিষ্ঠিত সমস্ত কবি-লেখক-নাট্যকার-অভিনেতা-অংকনশিল্পী-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীর অকুন্ঠ সমর্থন ও বিপুল ভালোবাসা আমি পেয়েছিলাম, আমার চলার পথে। বয়েসে আমি অতিতরুণ হওয়া সত্বেও তাঁরা আমাকে তাঁদের সহযোদ্ধা হিশেবে সমমর্যাদায় গ্রহণ করেছিলেন।
আমাদের দেশে কতিপয় তথাকথিত পণ্ডিত সাহিত্য সম্পাদক তাদের সম্পাদিত সাহিত্য পাতায় ছড়াকে ঠাঁই দিতে নারাজ। ছড়াকে ‘সাহিত্য’ মানতেই প্রবল অরুচি বা আপত্তি এদের। অথচ আজ থেকে একশ কুড়ি বছর আগে, বাংলা ১৩০৬ সালে যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘খুকুমণির ছড়া’ বইটির ভূমিকা লিখতে গিয়ে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ‘ছড়াসাহিত্য’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন। ছড়াকে প্রথম সাহিত্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছিলেন তিনি, লিখিত ভাষ্যে। নিকট অতীতে আমাদের দেশে ছড়ার জন্যে নির্ধারিত আসন ছিলো একমাত্র ছোটদের পাতা। ছোটদের পাতা থেকে ছড়াকে বের করে আনতে প্রাণপাত করতে হয়েছে আমাদের। ছড়া যে কেবল ছোটদের বিষয় নয় এটা বড়দের পাতেও(পাতায়) পরিবেশন করা যায় এবং সেটা করলে পাতাটির কোনো চরিত্রহানি হয়না বা এতে পাতাটির আভিজাত্য বিনষ্ট না হয়ে বরং তা আরো বর্ণাঢ্য হয়ে ওঠে, সেটা প্রথম অনুধাবন করেছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক দৈনিক জনকণ্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খান। অবশ্য বিষয়টি নিয়ে তাঁর সঙ্গে ওয়ান টু ওয়ান বৈঠক ও তর্ক করতে হয়েছে। আমার প্রশ্ন ছিলো—জনকণ্ঠের ‘চতুরঙ্গ’ পাতায় যেখানে দেশের খ্যাতিমান কলামলেখকেরা রাজনৈতিক কলাম লেখেন, সেখানে ছড়া কেনো ছাপা হবে না? আমার যুক্তি ছিল—কলামলেখকরা তাদের কলামটি লেখেন গদ্যে, আমি যদি সেরকম কোনো বিষয় বা ইস্যু পদ্যে বা ছড়ায় আনতে পারি তবে আপনি সেটা ‘চতুরঙ্গ’ পাতায় ছাপাবেন না কেনো? আমার ছড়াটাকে ‘পদ্য-কলাম’ হিশেবে দেখতে অসুবিধে কোথায়?
তোয়াব খান নমুনা দেখতে চাইলেন। তাঁর সামনে পেশ করা হলো সমসাময়িক রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে রচিত একটি ছড়া।
তোয়াব খান আমার যুক্তিটি মেনে নিয়ে সেটা কলামের গুরুত্ব দিয়েই ছাপালেন ‘চতুরঙ্গ’ পাতায়।
পরবর্তী সময়ে প্রচুর ছড়া লিখেছি আমি চতুরঙ্গে। জাপানের রাজধানী টোকিও থেকে এবং কানাডার রাজধানী অটোয়া থেকে পাঠানো আমার ছড়াগুলো আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীদের কলামের পাশেই সমান গুরুত্বে ছাপা হয়েছে তৎকালীন পাঠকপ্রিয় দৈনিক জনকণ্ঠে, বছরের পর বছর ধরে।
২০০১ সালে জামাত-বিএনপি চার দলীয় জোট সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর ব্যাপক হারে সংখ্যালঘু বিশেষ করে ‘হিন্দু’ নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিনাশ এবং মুক্তবুদ্ধিমুক্তচিন্তার মানুষদের ওপর নিপীড়নের খড়্গ নেমে এলে অনেকের মতো আমিও সোচ্চার ছিলাম জনকণ্ঠের পাতায়। ওদের অপশাসনের একবছর পূর্তির দিনে বিশাল একটা ফিরিস্তি তুলে ধরেছিলাম ছড়ার ছন্দে। ‘এক বছরে কি কি পেলাম’ নামের ছড়াটা তোয়াব খান ছেপেছিলেন পুরো দুই কলাম জুড়ে। ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত টানা একুশ ইঞ্চি ম্যাটার ছিলো ছন্দে ছন্দে। জনকণ্ঠের সেই আমলের পাঠকদের কারো কারো মনে থাকতে পারে। ওদের দুঃশাসনের চার বছর পূর্তিতেও লিখেছিলাম একই রকম দীর্ঘ ছড়া–‘চার বছরে কি কি পেলাম’।
বাংলাদেশে শিশুসাহিত্যের বাইরে বয়স্কজনপাঠ্য ছড়ার ক্ষেত্র নির্মাণে এবং পাঠক তৈরিতে তোয়াব খানের অবদানকে আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করি। এই বিষয়ে আরো কয়েকজন সাংবাদিক-সম্পাদকের ভূমিকাও স্মরণযোগ্য। সেই তালিকায় বিচিত্রা ও ২০০০ সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী, আজকের কাগজের আবু বকর চৌধুরী এবং আমাদের সময় সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খানও আছেন। যাঁদের অবদানের কথা অকুণ্ঠ চিত্ত্বে বয়ান করেছি আমি আমার অন্য একটি রচনায়, ছড়াসমস্ত বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডের ভূমিকায়।
আজকে আমি শুধু তোয়াব ভাইয়ের কথাই বলতে এসেছি।
০২
দৈনিক বাংলা এবং জনকণ্ঠের সম্পাদক হিশেবে নিজের যোগ্যতা ও অনন্য মেধার পরিচয় তিনি দিয়েছেন। প্রফেশনাল সাংবাদিক হিশেবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সেক্রেটারি ছিলেন। রাষ্ট্রপতি এরশাদের প্রেস সেক্রেটারী হিশেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে আমি সক্রিয় ছিলাম, এমনকি রাজপথেও। এরশাদ বিরোধী ছড়া এবং কার্টুন লিফলেট প্রকাশ করে পুলিশী হয়রানী থেকে বাঁচতে বাড়ি থেকে পালিয়ে থাকতে হয়েছে একাধিকবার। যৌবনের দীপ্ত সময়টার বিরাট একটা অংশ এরশাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনেই গেলো।
একবার ভয়ংকর বিপদে পড়েছিলাম সাপ্তাহিক ‘খবরের কাগজ’ পত্রিকায় বিটিভি অডিটোরিয়ামে একটি শিশুর ওপর যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে কলাম লিখে। এরশাদ তখন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী রাষ্ট্রপতি। সেই যৌন নিপীড়কটি ছিলো রংপুরসূত্রে এরশাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। তো কথিত সেই আত্মীয়ের প্ররোচনায় রাষ্ট্রপতির সামরিক এটাচে আমাকে তুলে নিয়ে হাড্ডি-মাংস আলাদা করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। এক শুভাকাঙ্খীসূত্রে খবর জেনে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম গোপন আশ্রয়ে। আমাদের এক বিখ্যাত সাংবাদিক আমার সেই বিপদের খবরটি তোয়াব খানের কাছে পেশ করে বলেছিলেন সত্য প্রকাশের দায়ে আমার জীবন হুমকির মুখে। শিশুর প্রতি যৌন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লিখে এরশাদের কথিত আত্মীয়ের রোশানলে পড়ে আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছি। সে যাত্রায় নিজে উদ্যোগী হয়ে আমাকে রক্ষা করেছিলেন তোয়াব খান।
০৩
আমার একটা চাকরি দরকার। ইত্তেফাকে আমার ঘনিষ্ট বিখ্যাত দুই সাংবাদিক রাহাত খান ও আবেদ খান আমার চাকরির ব্যবস্থা করলেন সম্পাদকীয় বিভাগে। একজন কম্পোজিটর আমার নিয়োগপত্রটি কম্পোজ করতে গিয়ে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বিষয়টা জানিয়েছিলেন সহকর্মীদের। এক কান দুই কান হতে হতে খবরটা গিয়ে পৌঁছেছিলো দাদাভাইয়ের কানেও। মালিকপক্ষের সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে বৈঠক করে আমার নিয়োগটিকে রুখে দিয়েছিলেন দাদাভাই। হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন রাহাত ভাই আর আবেদ ভাই দু’জনেই। জেনে আমি খুব কষ্ট পেলেও মুখে কিছুই বলিনি দাদাভাইকে। সম্পর্ক মুছে ফেলতে পারিনি।
জনকণ্ঠ তখন মাত্র বেরিয়েছে। পত্রিকা জগতে হইহই কাণ্ড। বিপুল পাঠক গ্রহণ করেছিলো পত্রিকাটিকে, শুরুতেই। দেশের চারটি অঞ্চল থেকে একযোগে মুদ্রিত হতো। অফিস ছিলো মতিঝিলে।
সেই দুঃসময়ে সাংবাদিক আবেদ খান একদিন বললেন আমার জন্যে জনকণ্ঠে একটা ভালো চাকরির ব্যবস্থা তিনি করেছেন। সম্পাদক তোয়াব খানের সঙ্গে এ বিষয়ে বিস্তারিত এবং ফাইনাল কথাবার্তাও বলা শেষ। এখন আমার দায়িত্ব দ্রুত, পারলে আগামীকালই একটা সিভি নিয়ে তোয়াব খানের সঙ্গে দেখা করা।
কথামতো আমি একটা খামে আমার সিভিটা ভরে তোয়াব খানকে ফোন করে এপয়েনমেন্ট নিলাম। তিনি খুব আনন্দিত কণ্ঠেই আমাকে যেতে বললেন। নির্ধারিত সময়ে হাজির হলাম মতিঝিলে তাঁর শীতল কক্ষে। তাঁর কক্ষটা খুব বড় ছিলো না। টেবিলটাও। দরোজার দিকে মুখ করেই তাঁর আসন। তাঁর টেবিলের অপর প্রান্তে দরোজার দিকে পেছন ফেরা এক ভদ্রলোক আগে থেকেই বসেছিলেন। আমাকে ঢুকতে দেখে সেই ভদ্রলোক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন আমার দিকে। তিনি এখলাস ভাই। বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক এখলাসউদ্দিন আহমেদ। জনকণ্ঠের ছোটদের পাতা দেখেন। টেলিফোনে যতোটা আন্তরিক ছিলেন সামনা সামনি ততোটাই শীতল কণ্ঠে তোয়াব ভাই আমাকে বললেন–সিভিটা রেখে যান। আমাদের দরকার হলে আপনাকে জানানো হবে। (তখন তিনি আমাকে আপনি সম্বোধন করতেন।) এমন কি তোয়াব ভাই আমাকে বসতেও বললেন না।
নিয়তি এখানেও ইত্তেফাকের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে তৎপর ছিলো। এখলাস ভাইয়ের কারণেই তোয়াব খান আমার নিয়োগের ব্যাপার থেকে সরে দাঁড়ালেন। দাদাভাইয়ের মতো এখলাস ভাইয়ের সঙ্গেও আমি স্বাভাবিক সম্পর্ক চালিয়ে গিয়েছি। কারণ আমি নিজের সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলাম। কনফিডেন্ট ছিলাম। আমি জানতাম তাঁরা কেউই আমাকে আমার প্রাপ্য সম্মান মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠা থেকে বিচ্যুত করতে পারবেন না। আমার যেখানে পৌঁছুবার কথা সেখানে আমি পৌঁছাবোই। আজ কিংবা কাল। আমার ধারণা সঠিক ছিলো। তবে লড়াইটাও কঠিন ছিলো। প্রতিকুল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াইটা আমার পরিবার থেকেই তো শুরু। সুতরাং আমি হতাশ হইনি বা ভেঙে পড়িনি।
তোয়াব ভাই আমাকে জনকণ্ঠে চাকরি না দিলেও তাঁর প্রতি আমার কোনো অভিমান বা ক্ষোভ ছিলো না। আমি তাঁকে পত্রিকা জগতের এক অনন্য নক্ষত্র হিশেবে উচ্চ মর্যাদার আসনে রাখতাম। আজও রাখি। জনকণ্ঠে আমাকে চাকরি না দিলেও তিনি আমার সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় সচেষ্ট ছিলেন বরাবরই।
২০০১ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ দূতাবাস টোকিওতে ফার্ট সেক্রেটারি প্রেস হিশেবে দায়িত্ব পালন করতে জাপান গিয়েছিলাম। তার কয়েকমাস পরেই ছিলো নির্বাচন। আমার শুভাকাঙ্খীরা (কেবলমাত্র হাশেম খান ছাড়া) সকলেই আমাকে বারণ করেছিলেন শেষ সময়ে ওরকম একটি নিয়োগ মেনে নিয়ে জয়েন করতে। কিন্তু আমি গিয়েছিলাম। দেশের প্রধানমন্ত্রী আমাকে সম্মানিত করতে চেয়েছেন ওই নিয়োগের মাধ্যমে। আমি জয়েন না করলে প্রধানমত্রীকে অসম্মান করা হয়। আমি সেটা করবো কেনো?
টোকিও দূতাবাসে যোগদানের চার মাসের মাথায় অক্টোবরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এসে প্রথম দিনেই ১৮ জন কর্মকর্তাকে জনস্বার্থে চাকুরিচ্যুত করেছিলো। তালিকায় একমাত্র আমিই ছিলাম ভিনদেশে কোনো দূতাবাসে কর্মরত। দূতাবাসের কোনো কর্মকর্তাকে যে নিয়মে চাকরিচ্যুত করতে হয় আমার ক্ষেত্রে তার কোনো নিয়মই পালন করা হয়নি। একটি ফ্যাক্স বার্তায় আমার নিয়োগ বাতিল করা হয়েছিলো। আমার বেতন ভাতা এবং বাড়ি ভাড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো সেই মুহূর্তেই। টোকিওর মতো খরুচে একটি শহরে খুবই অমানবিক অর্থকষ্ট ও দারিদ্র্যের অকূল সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম আমি স্ত্রী এবং কন্যাকে নিয়ে। সেই সময়ে পৃথিবীর দ্বিতীয় খরুচে শহর ছিলো টোকিও। প্রথ শহরটি ছিলো জুরিখ।
বিদেশের মাটিতে আমাকে ভাতে এবং পানিতে মারার ব্যবস্থা করেছিলো হাওয়া ভবন ও জামাত-বিএনপি। ইলেকট্রিক বিল পরিশোধের ভয়ে রাতে পুরো বাড়ি অন্ধকারে রেখে একটিমাত্র কক্ষে আলো জ্বালিয়ে রাখতাম। পানি খরচ করতাম মেপে মেপে। নভেম্বর-ডিসেম্বর-জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি চার চারটি মাস কী যে দুঃসহ জীবন গেছে আমার বেতন ভাতাহীন! কিন্তু আমি আপস করিনি। জামাত-শিবির তথা একাত্তরের ঘাতক দালাল রাজাকার আলবদর যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আমার ঘৃণা জারি ছিলো। ধর্মান্ধ মৌলবাদী
সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আমার ঘৃণা জারি ছিলো। যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হয়েছিলো চার দলীয় জোট সরকারের। সেই সময়ে ‘মানচিত্র’ নামের স্থানীয় একটি জনপ্রিয় পত্রিকা আমার সাক্ষাৎকার ছেপেছিলো। আমার বক্তব্য থেকে উদ্ধৃত করে পত্রিকাটি শিরোনাম করেছিলো–‘ঘাতক নিজামী যে সরকারের মন্ত্রী সেই সরকারের অধীনে আমি চাকরি করতে রাজি নই’। আমার ওপর তখন নেমে এসেছিলো ভয়ংকর প্রতিশোধমূলক সরকারি নিয়ম বহির্ভূত কর্মকাণ্ড। সেই সময়টায় জনকণ্ঠে নিয়মিত আমার ওপর সরকারের নির্যাতনের স্টিম রোলার চালানোর খবর গুরুত্বের সঙ্গে ছাপতেন তোয়াব ভাই। দেশের মানুষ জনকণ্ঠ মারফত জানতে পারতেন বিদেশের মাটিতে তাঁদের এক ছড়াকারের দুর্বিষহ অমানবিক জীবন যাপনের সাম্প্রতিক খবরাখবর।
এক পর্যায়ে ২০০২ এর ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখে টোকিও থেকে স্ত্রী-কন্যাসহ আমি পালাতে সক্ষম হয়েছিলাম। চলে গিয়েছিলাম নিউইয়র্কে। দেশে তখন মুক্তবুদ্ধি মুক্তচিন্তার মানুষেরা বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির বিখ্যাত মানুষেরা চরম লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন প্রতিদিন। কাউকে কাউকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠানো হচ্ছিলো। আমি দেশে ফেরার জন্যে ব্যাকুল ছিলাম। কিন্তু কোনো শুভাকাঙ্খীর সমর্থন পাচ্ছিলাম না। গোয়েন্দাসংস্থায় কর্মরত আমার একাধিক বন্ধু আকারে ইংগিতে বারণ করলেন। এক রাতে ওয়াশিংটন থেকে তোয়াব ভাইকে ফোন করে বললাম–আর ভালো লাগছে না তোয়াব ভাই। এবার আমি দেশে আসতে চাই। আপনার সমর্থন পেলেই রওনা হবো।
শুনে তোয়াব ভাই খানিকক্ষণ নিরব থেকে বলেছিলেন,–তুমি দেশে থাকো এটা তো আমি অবশ্যই চাই। কিন্তু আমি তোমাকে আমার নিউজ আইটেম হিশেবে পেতে চাই না রিটন।
তোয়াব ভাইয়ের কথায় এবং কণ্ঠে স্নেহ ছিলো, মমতা ছিলো। ভালোবাসা ছিলো। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে যেটা ছিলো সেটা উৎকণ্ঠা। যেটা প্রিয়জনের জন্যেই হয় কেবল। বুঝে গিয়েছিলাম যা বোঝার।
এর কিছুদিন পরেই আমি চলে এসেছিলাম কানাডায়, নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। আমার পাসপোর্ট বাতিল হয়েছিলো। এবং সাত বছর আমাকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিলো নাগরিক হিশেবে প্রাপ্য সবুজ একটি পাসপোর্ট থেকে। সে আরেক দীর্ঘ কাহিনি।
আমার জীবনের বিপদের সময় তোয়াব ভাইয়ের পাশে থাকার কথা আগেই বলেছিলাম। কানাডায় আমার দুঃসহ প্রবাস জীবনে টানা সাত বছর জনকণ্ঠে আমি গদ্যপদ্য মিলিয়ে বিপুল সংখ্যক রচনা লিখেছি। তোয়াব ভাই সেগুলো ছাপতেন খুব যত্ন করে। নিয়মিত। চতুরঙ্গ পাতায়।
০৪
১৯৯৯ সালে কলকাতায় একবার দেখা হয়েছিলো তোয়াব ভাইয়ের সঙ্গে। তখন একটা কাণ্ড করেছিলাম। যা আজও বলা হয়নি তোয়াব ভাইকে। আজকে বলেই ফেলি ঘটনাটা।
১৯৯৯ সালে কলকাতা বইমেলার থিমকান্ট্রি ছিলো বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিশেবে উপস্থিত ছিলেন উদবোধনী অনুষ্ঠানে। বাংলাদেশ থেকে কবি-লেখক-সাংবাদিকের বিরাট এক বহর সেবার বইমেলায় গিয়েছিলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রযত্নে। বিশাল বহরের একজন ছিলাম এই আমিও। কিড স্ট্রিটের এক হোটেলে (ওরিয়েন্টাল সম্ভবত) আমার ঠাঁই হয়েছিলো। হাঁটার দূরত্বেই ছিলো একটা রেস্টুরেন্ট। এক রাতে ওখানে খেতে গিয়ে দেখি দূরের একটা টেবিলে তোয়াব ভাই। তাঁর সঙ্গে একজন ভদ্রমহিলাসহ মোট চারজন। তাঁরাও এসেছেন রাতের খাবার খেতে। আমি উঠে গিয়ে সালাম-কুশল বিনিময় করে এলাম। তারপর খাওয়া-দাওয়া সারলাম দ্রুত। চায়ে চুমুক দিতে দিতে খাবার সরবরাহকারী লোকটাকে বললাম–ওই যে ভদ্রলোক তিনজন সঙ্গীসহ খাচ্ছেন তাঁরা আমার অতিথি। আমার বিলের সঙ্গে তাঁদের বিলটাও ধরবেন। চারটে চাসহ। আমি চলে যাবার পর ওঁরা যখন বিল দিতে বলবেন আপনাকে, তখন আপনি বলবেন এই টেবিলে বসা মছুয়া লোকটা বিল পরিশোধ করে গেছে।
লোকটা বিল নিয়ে এলেন। বিল মিটিয়ে ভালো একটা বখশিস তার হাতে গুঁজে দিলাম–এই নিন আপনার টিপ্স্।
আমি জানিনা সেই মেসিয়ার লোকটা তোয়াব ভাইকে ঘটনাটা ঠিকমতো বলতে পেরেছিলো কি না। না পারলেও ক্ষতি নেই। কে বিল দিয়ে গেলো সেটা তোয়াব ভাই বুঝতে না পারলেও ক্ষতি নেই। কাণ্ডটা আমি করেছিলাম আমার নিজের আনন্দের জন্যে। কেউ না জানুক আমি তো জানি। সেই আনন্দটুকু একান্তই আমার।
আজ ২৪ এপ্রিল কিংবদন্তী সাংবাদিক সদা পরিপাটি তোয়াব খান, আমার প্রিয় তোয়াব ভাইয়ের ৮৬ তম জন্মদিন। জন্মদিনে তাঁকে ঘিরে আমার কুড়ি বছর আগের আনন্দের স্মৃতিটা বন্ধুদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিলাম। জীবন এক অপার রহস্যের নাম। সেখানে লুকিয়ে থাকে অনেক না বলা ব্যথা অভিমান কষ্ট আর আনন্দের উপাখ্যান। কলকাতার রেস্টুরেন্টের ঘটনাটা এখন হয়তো তোয়াব ভাইয়ের কানেও পোঁছুবে। তাঁর অপরূপ স্নিগ্ধ হাসিমাখা মুখটা কল্পনায় দেখতে পাচ্ছি!
হ্যাপি বার্থ ডে তোয়াব ভাই!
অটোয়া ২৪ এপ্রিল ২০১৯