Wed, Jul 28, 2021 6:45 AM
সঙ্গীতা ইয়াসমিন
“সে যে ছুঁয়ে গেল নুয়ে গেল রে
ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত...
সে যে চলে গেলে বলে গেল না...
সে কোথায় গেল, ফিরে এল না।”
শত শত ফুল ফোটে নিত্য অনুরাগে, বসন্তের গানে গানে। সব ফুল কি ছুঁয়ে যায় হৃদয়? কেউ কেউ ছোঁয় বটে! কেউ কেউ থাকে স্মৃতিতে সুগন্ধী বকুল হয়ে। ‘বকুল’ শব্দটি মনে আসতেই কোথা থেকে যেন সুতীব্র মিষ্টি গন্ধ এসে নাকে লাগে। বকুল কথায়ও সুগন্ধি থাকে, মায়া থাকে, প্রেম থাকে, থাকে অনুরাগ জমা স্মৃতির আস্তিনে। বকুলের ছবি মনে এলে চোখে ভাসে হালকা ঘি রঙের মনোহরী ডিজাইনের ছোট্ট মায়াবী ফুল। বকুলের আদলে নারীদের কানের দুলও হয়। যেকোনো ফুলের সাথেই নারীর এক চমৎকার মিল, ভাবে-স্বভাবে। ফুল যেমন নারীর শ্রীবৃদ্ধি করে তেমনি নারীর অঙ্গে শোভা পেয়ে ফুলের জন্মও ধন্য হয়! আর কারও বেলায় এ কথা সত্য নাও হতে পারে, তবে বকুলের বেলায় এ ই ধ্রুব সত্য। অন্য ফুলেদের একাধিক ব্যবহার থাকলেও বকুলকে কেবল মোহনীয়া কারও খোঁপায়ই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পেঁচিয়ে বসতে হয় মালা হয়ে। তাছাড়া তার জন্ম মাহাত্ম্যই নিরর্থক হয়ে যায়।
আমাদের শিল্প সাহিত্যের নানা অঙ্গনে অনেক ফুলের মত বকুলও বিশাল জায়গা জুড়ে আছে নিজগুণে। কবিতা, গানে, গল্পে নানা উপমায় বকুল এসেছে বহুবার। যেখানে চোখ ধাঁধানো রূপের থেকে মন ধাঁধানো গুণই প্রাণ কেড়েছে সকল সৃষ্টিরসে। বকুলকে নিয়ে প্রেমের কবির চির পরিচিত সেই গান কোটি বাঙালীর অন্তরে চিরদিন সুর তুলবে।
"তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে।"
এই গানটি যতবারই শুনি আমার মনে একটা প্রশ্ন উঁকি দেয়, বকুলকে কি মাড়িয়ে যাওয়া যায়? সেও কি সম্ভব? অমন চকচকে রঙের ঔজ্জ্বল্য, সে নিভে যেতে যেতেও রাখে প্রদীপ জ্বালিয়ে, দশদিক আলো করে। কোমল অথচ সুদৃঢ়, সহজে দুমড়ে মুচড়ে যায় না। ধূপের মত পোড়া নিঃশেষেও সুগন্ধী বিলায় সে। দীর্ঘসময় থাকে না সে জন্মভিটায়, ঝরা বকুলই তাই আমাদের প্রার্থিত। তাকে কুড়িয়ে বুকে করে রাখতে হয়। নইলে সে পথিকের পা আগলে বলে-
"বকুলের মালা শুকাবে রেখে দেব তার সুরভী
দিন গিয়ে রাতে লুকাবে, মুছো নাকো আমারই ছবি।"
মজার ব্যপার হল এই ‘আমি’টা এখানে বকুলও! গীতিকবির এই আকুলতা কোনো এক মানবীর অন্তরের কথা হলেও বকুলের সাথেই সেই নারী মনকে তুলনা করেছেন তিনি। সেই হিসেবে এই ছবিখানা অন্তরে ধারন করার এই যে আকুল চাওয়া সে বকুলের নিজেরও। বকুল পুরোনো হলে তার শ্রী কিছুটা হীন হয় বটে, তবে গন্ধের চমক ছড়িয়ে পড়ে হাজার দিকে, সে যেন পরিণত যৌবনা সম্পূর্ণা নারীর মতোই। পরিমিতি বোধে বেড়ে ওঠা মননের সমৃদ্ধ নারীমন তো বকুলই। যেখানে সে পায়ের চিহ্ন ফেলে, সবটুকু সুগন্ধী ছড়িয়ে জানান দেয়, সে বকুল। সেদিক থেকে বকুলের সাথে নারীমন-জীবনের এক অপূর্ব মেলবন্ধন আছে বলা যায়।
কিছু ছবি হৃদয়পটে চিরকাল অমোছনীয়ই রয়ে যায়। স্মৃতির এলোমেলো বাতাস হঠাৎই নিয়ে যায় এক লহমায় সুদূর অতীতের ফেলে আসা পথের ধারে, যদি চেনা কোনো গান রিণরিণিয়ে বেজে ওঠে মনের কোণে! নিমেষেই ঘুরে আসা যায় হাজার বছর পেছনেও। হঠাইৎ যদি অতীত এসে দোলা দেয় কোনো নতুন পথের বাঁকে, পুরোনো স্মৃতিরা গন্ধে মাতাল হয়ে নেশা জাগায় হৃদয়পুরে।
আমারও কৈশোরের বারান্দায় ছায়া হয়ে, মায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজোড়া জ্বলজ্যান্ত বকুল। জোড়া বকুলের নামেই বকুলতলীর মাঝিঘাটা ছিল আমাদের শৈশবে। আমার রোজ দিনের পথের পাড়ের সে ঘাট, মায়ায় বাঁধা সেই বকুল তলা। সারাটা পথ কাঁচা সোনায় মুড়ে আমার যাওয়া-আসার পথে নরোম গালিচা বিছিয়ে রাখত। আমি নিয়ম করে প্রতিদিন মায়ের বকুনি কিনতাম বকুলের বিনিময়ে। জোড়া বকুলের বয়স বেড়েছিল, মিঠেলি খালের পাড়, সইতে পারেনি সে ভার। জোয়ার ভাটার স্রোতের টানে একই সাথে হল দোঁহের সলিল সমাধি। আহা বকুলতলীর ঘাট! চিনচিনে ব্যথা বাজে মনে এলে।
এই তো নিয়ম! প্রকৃতি যখন তার পৃষ্ঠে আমাদেরকে বইতে পারে না আর, তখনই তো চলে যেতে হয় আমাদেরকে সব খেলা সাঙ্গ করে। এই যে কত বকুল, গোলাপ, রজনীগন্ধা ঝরছে গেলো দু’বছরে! এও কি প্রকৃতির ভার বহনের অক্ষমতা! হয়তো! কে জানে তার অপার রহস্যের গোপন কলকাঠির কথা?
গ্রীষ্মের লম্বা দিন, নিয়ম করে প্রতিদিন বিকেলে হাঁটতে বেরোই। হঠাতই একদিন পথের মাঝে পথরোধ করে দিল কে যেন! পা দু’টোকে থামিয়ে দিয়ে বলল, দাঁড়াও পথিক! কী যে মিষ্টি এক সুগন্ধে এলোমেলো করে দিয়েছিল মন! কাছে যেতেই মনে হল এ আমার চিরচেনা গন্ধ, চিরযৌবনা প্রেমের মতই টানে আমায়। স্মৃতি হাতড়ে খুঁজে পেলাম, সে আর কেউ নয়, আমার বকুলপ্রিয়া।
বকুলতলির প্রেমের মুকুল নিয়ে গেল স্মৃতিজাগানিয়া ব্যথার নীড়ে। আবিষ্কার করলাম মুহূর্তেই ভীনদেশী বকুলকে। এখানকার গাছটার তলায়ও জমেছিল অসংখ্য ঝরা বকুল। আমায় এসে কানে কানে বললে, লেখ না আমায় নিয়ে দু’কথা! আমি বড় অনাদরে ফুটে থাকা বকুল গো! গন্ধ বিলাই আপন মনে। আহা! কেউ তো ডাকে না আমায় বকুলপ্রিয়া নামে। এদেশী ললনারা জানে কি বকুলের কদর, পরে না তো কেউ খোঁপায় তাকে!
আমার ভিনদেশী বকুল। রাখি তোমায় বুক পকেটের খামে
ডাকি ভালোবাসার নামে,
যদি সে আসে ফিরে, নৈবেদ্য সাজাই, দেব তার পায়ে।
আমার পরবাসী বকুল।
সাক্ষী থাকুক দীর্ঘশ্বাস আর এলোমেলো চুল।
আমার রাতজাগা বকুল, আমার কূল হারানো কূল।
আহা ভীনদেশী বকুল।
লেখক :সঙ্গীতা ইয়াসমিন,টরন্টো, কানাডা।