Thu, Nov 16, 2017 7:52 PM
লুনা শিরীন : টরোন্টোতে ইফতার কয়টায় হয় জানিস তুই বীথি ? রাত নয়টা ৩ মিনিটে, যদিও তখন বাইরে উজ্জল দিনের আলো। বলেছি তোকে আগের চিঠিতে,নাইয়া ডালাসে আছে। মাদার তেরেসা কি করে বলেছিলেন -- পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে একাকিত্বের দারিদ্রতা – কি করে উনি জানেন আমার মতো এমন লক্ষ মানুষের একাকিত্বের যন্ত্রনার কথা ?
বীথি, মাত্র ১৫/১৬ বছর আগে, আমি ঠিক এই মুহুর্তে যে জীবনটা যাপন করছি, এই জীবনটার জন্যই তৃষ্ণার্ত হয়ে ছিলাম। তাহলে আজকে সেই জীবনটা পাবার পরেও হাহাকারের গান গাইছি ? কেন গাইছি একাকিত্বের গান ? জীবনের হিসেব মেলে না কিছুতেই বীথি ,কারোই মেলেনি কোনদিন। গমগমে এক ভরা সংসারে বড় হয়েছি, চারবোন বাবা / মা , মামা খালা, আর পাড়া প্রতিবেশী দিয়ে ভরে থাকতো মায়ের বিশাল বিপুল সংসার । মাত্র এইট পাশ করা আমার মা, যার সাথে বাবার ১৩ বছরের বয়সের ফারাক ছিলো, কিন্তু আমরা বুঝতে পারতাম না আমার মা কম কিসে ? বরং বাবাকেই ক্ষমতাহীন মনে হয়েছে আজীবন। শুধু আমরা না ,আমাদের পরিবারকে যারা কাছে থেকে চেনেন সবাই একবাক্য স্বীকার করবেন সেকথা । ক্যমন করে আমার মা এমন অদম্য সাহসী মহিলা হলেন ? আজন্ম আমাদের কাছে আম্মা শিকল ভাঙ্গার গান গাইতেন ,মা বলতেন – রান্না করা আর বাচ্চা জন্ম দেবার জন্য আলাদা গুন লাগে না, গুন লাগে ক্লাসে প্রথম হবার জন্য।
আমার মায়ের ওই এক নেশা,পড়াশোনায় কে সবচেয়ে ভালো,মায়ের কাছে তার সাতখুন মাফ। কেন আমার মা এমন মানুষ ? প্রশ্নটা আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় বীথি। কখনো আম্মা নিজের জন্য কিছু করতেন না। বা শুধু আমাদের জন্যও না । আম্মা ভাবতেন একটু বড় করে,সবাইকে নিয়ে, আজন্ম আম্মার মুখে একটা কথা শুনেছি আমি—কেউ খেলে কোনদিন কমে না লুনা , তুই তোর বাপের মতো হয়েছিস শুধু নিজে্র-টা বুঝিস। আম্মার কাছে গালি খেয়েছি সারাক্ষণ – মায়ের এই এক স্বভাব ,মানুষকে ডেকে ডেকে আপ্প্যায়ন করা,আদর করা, ভালোবাসা,আমি যত বড় হয়েছি তত স্বপ্ন দেখেছি,বাইরের জগত আমি বাইরেই ফেলে আসবো,ঘর হবে নীরব নির্জন শান্ত। তাই তো আছি বীথি । আজকে এই শহরে , বিদেশ বিভুই এ--- কেউ আমাকে বিরক্ত করে না, অনেক আগে থেকে না বলে কেউ কোনদিন আমার বাসায় উকিও দেবে না, তাহলে আজ কেন মনে পড়ে শুধু অতীত। প্রিয় দেশ, ফেলে আসা সময় ? কেন আজকে ইফতার টেবিলে একা বসতে গেলে মনে হয় এর চেয়ে দোখজ ভালো ? আজকে কেন মনে হয়, ছোলা নেই, বড়া নেই, পিয়াজী নেই, সবার প্লেটে প্লেটে মা ইফতারী বেড়ে দিচ্ছেন না,আমাকে দুটো বেগুনী কেন বেশী দিচ্ছে না,কেন আমি এক গ্লাস শরবত আগে থেকে লুকিয়ে রাখছি না, কেন মা মেহমানকে আসতে বলে, আমার যে ইফতারে কম পড়ে যায় মা সেটা বোঝে না কেন ? এসব কথা ভেবে ভেবে আজ কেন আকুল হয়ে কাঁদছি বীথি, বলতে পারিস তুই ?
আমার নীরব বাসা, ছুটির দিন,আমি ইচ্ছে করলেই যা মনে আসে তাই করতে পারি, কিন্তু কেন শুধুই তোর সাথে কথা বলি আর কাদতে থাকি,কেন বীথি ? কোথায় গেলো আমার আরো আরো ছোটবেলার সেই নানীবাড়ির ইফতারের দিনগুলো ? নানী গুঁড় দিয়ে শরবত বানাতেন,একটু লালচে হয়ে আসা পানি, আবার কোন কোন দিন নানী দুপুরে একবার খেতে বলতেন আমাকে, তাহলে নাকি দুইটা রোজা হবে, সব সব দিনগুলো হারিয়ে গেলো বীথি,জীবন থেকে সব সব হারিয়ে কেন যায় ? এই প্রশ্নের মীমাংসা হলো না এক জীবনে ।
কি ভীষন ভাবে অতীত মনে পড়ে ,বিদেশে না আসলে কোনদিন এই অনুভুতি জানতে পারতাম না। এই তো ১৯৯৫ থেকে ২০০৪ অব্ধি আমি কাজ করতাম বাংলাদেশের গ্রামে / মাঠে / প্রান্তরে – এনজিওর কাজে কাজে সারা জেলাময় ঘুরে বেরিয়েছি আমি। কত গরীব মানুষ , শুধু এক বেলা পেটপুরে ভাতের জন্য কত ধরনের কাজের সাথে নিজেকে জড়িত করছে সেইসব মেহনতি দুঃখী মানুষেরা । আজকে দুপুরে নিজের জন্য রান্না করতে গিয়ে মনে পড়লো কুড়িগ্রামের জোহরার কথা, আমাকে বলেছিলো – মোক একনা ভাত দেন বুবু, পেটে ভুখ লাগছে – কি অসহায় জোহরা , শুধু একমুঠ ভাত চেয়েছিলো আমার কাছে ,ব্র্যাকের কাজে জোহরাকে অতি-দরিদ্র প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছিলো। কিন্তু এমন কত শত শত জোহরা তো বাংলাদেশে নিত্য মরছে ক্ষুধার জ্বালায় । আর আমার এই শহরে আমি চাইলেও কোন গরীব মানুষ পাবো না ,আমি ডাকলেও কেউ আমার কাছে এসে,আমার পাশে বসে ইফতার করবে না। কি অদ্ভুত এই একই পৃথিবীর রূপ , তাই না বল ?
আজকে দাড়িয়ে ছিলাম বাসস্টপে , দেখি একজন লোক কিছু ডলারের চেঞ্জ চাইছে , বেশভদ্রভাবে , বলছে বাসে উঠার চেঞ্জ নেই, দেখি এরপরে বার বার সিগন্যালে থামা গাড়িগুলোর কাছেও চাইছে, কেউ না বললে তাকে আবার ধন্যবাদ দিচ্ছে । আমি ভাবছি , এই যে আমার মা , সারা রোজার মাস ধরে অনন্ত ১০ জন গরীব মানুষকে ভালোবেসে খেতে দেয় ,পয়সা দেয় , কই আমি ডাকলে কি এই চেঞ্জ চাওয়া মানুষটা আসবে ? বীথি, জীবনের এই মধ্যবয়সে বিদেশে এসে যে এমন করে অতীত পেয়ে বসবে সেটা কোনদিন ভাবিনি রে, আজ এই অবেলায়,কেবলই মনে হয় মা ঠিকই বলেন – শুধু নিজের কিসে সুখ হবে এই দেখলাম জীবনভর,আর কিছুই করা হোলো না । একটাই মাত্র জীবন তবুও কত কত স্বপ্নের দোলাচল, কবে গাইবো সেই গান – আবার জমবে মেলা , বটতলা,হাটখোলা । আদর তোকে বীথি ।
৪ /০৭/২০১৪
আরো পড়ুন : বীথির কাছে চিঠি-৩৮