Wed, Oct 25, 2017 12:36 PM
লুনা শিরীন: আবার বসলাম তোর সাথে কথা বলতে। আজ ভোরে আমার ছোটবেলার এক পারিবারিক শিক্ষক, আমাদের পরিবারেরও খুব আপনজন নুরু স্যার এর সাথে কথা হচ্ছিলো। স্যার কিছুক্ষণ কথা বলেই আমাকে বললেন – আরো লিখো লুনা , আমি তোমার লেখা পড়ি। আমি স্যারকে বললাম, আমি নিজের যন্ত্রনা থেকে রিলিফ পেতেই লিখবো স্যার, নিজের তাগিদেই লিখবো। কিন্তু আপনি যে সময় করে পড়েন সেটা জেনে ভীষন ভালো লাগছে ।
আসলেই কিন্তু কথাটা তাই, জানিস বীথি- অনেকেই হয়তো মনে করে কেন লিখি ? আমি যদি বলি আপনি চাকরি করেন কেন ? আপনি আড্ডা মারেন কেন ? বিশেষ করে সেক্স করেন কেন ? কারন আপনি বাচতে চান তাই না ? আমি ও লিখি কারন আমি বাঁচতে চাই, আমার একটা জানালা দরকার যেখানে দাড়িয়ে আমি আকাশ দেখি, নিজেকে দেখি, নিজেকে প্রকাশ করি তাই আমি লিখি। না লিখলে হাত ব্যাথা করে তাই লিখি ।
খুব অতীত মনে পরে রে বীথি। বিপদের সময় বেশি করে অতীত মনে পরে, ভাবি কি হতে পারতো ? ভাবি, অন্যরকম কিছু কি হতে পারতো জীবনে ? এমন সময়গুলোতে বাবার কথা খুব মনে পরে বীথি। বাবার কথা মনে পরে- কারন বাবা সংসারের প্রধান ছিলেন। দায়িত্ব বাবার ঘাড়ে ছিলো । আমার জীবনের দায়িত্বও আমার ঘাড়ে। আর সাথে আমার ছেলের দায়িত্ব । এই জীবন আমি নিজে বেছে নিয়েছি। এখানে কারো কোন দায় নেই, এই দায়িত্ব সময় সময় ভীষণ দায় মনে হয় বীথি। আমি ভাবি, চারপাশে যে মেয়েদের দেখি, যারা মেয়ে বন্ধু তাদের দায় বা দায়িত্ব কি স্বামীরা নিয়েছে ? জানিনা বীথি।
এই প্রসঙ্গে আর কথা না। বরং কয়েকদিন হলো এই বিপদে বাবার কথা কেন মনে পরছে সেটা বলে একটু হাল্কা লাগে কিনা দেখি, ক্যামন ? আমার বাবাকে তোর মনে পড়ে ? শুধু অফিস যেতেন আর বাসায় ফিরে খাতা /পত্র নিয়ে বসে থাকতেন। আর মা তাকিয়ে থাকতেন সারা মাসের বেতনের দিকে। এইটুকু মনে পরে, আর ছুটির দিনে বাবা নিজের কাপড় নিজে ধুতেন। আমরা চারবোন থাকার কারনেই মা আমাদের তেমন বিশেষ দিয়ে/থুয়ে বড় করেননি, যেমন ধর বড় করে কোন জন্মদিন আমাদের হোতো না, আমরা বছরে এক –দুইবারের বেশী কাপড় পেতাম না। আবার হুট করে কোন ভালো খাবার আমরা খেতাম না । অন্যদিকে বাবার সাথে দূরত্ব থাকার কারনে এবং মাকে ভয় পাবার কারনে বাবা / মায়ের সাথে যে ছেলেমেয়েরা অনেক বেশী আপন হয় সেটা জেনেছি অনেক অনেক পরে ।
কিন্তু আমাদের মন কি আম্মা দমিয়ে রাখতে পারতেন ? আমাদের আশে পাশে সব সময় আমাদের চেয়ে বেশী সলভেন্ট পরিবার বাস করতো। এই যেমন তুই বীথি , তোর বাবা সেই সময় মানে ১৯৮২/৮৩ সালেই আইএলও -- তে কাজ করতেন, চাচা জেনেভা যেতেন প্রায় প্রতিমাসে,তোর জন্য কি না আনতেন বল? কিন্তু আমার বাবা ঠিক সেই সময় খুব জোড় যেতেন নেপাল , বা ভারত , আর বাবা বিদেশে যাওয়া মানেই আমাদের হায়েস্ট পাওয়া হচ্ছে সেই প্লেনে দেয়া ছোট এক টুকরো সাবান বা একটা হাল্কা পটকা ব্রাশ, তবুও ওই জিনিস হাতে পাবার সাথে সাথেই মনে হতো ,আহ আকাশে উড়লে এরকম আর কি কি দেয় ? এখন আজকে এই ৪৫ বছর বয়সে বুঝতে পারি, আমাদের গোটা গ্রামে,গোটা জেনারেশনে বাবা একমাত্র শিক্ষিত সরকারী কর্মচারী – প্রথম মানুষ ঢাকায়,এর চেয়ে আর কত দুর বেশী যাবেন বাবা ? মানুষের যে সামর্থ্যর সীমাবদ্ধতা থাকে , মানুষের যে নিজেকে বিকাশ করারো একটা লিমিট থাকে, এবং সেটাও যে মানুষ এক জীবনেই বুঝে যায় কিন্তু বলতে পারে না । নিজের বঊ /বাচ্চা / ভাই বোন / নিজের বাবা মাকে তা আমরা পরিবারের অংশ হয়েই বুঝতে পারি না, আর যখন বুঝতে পারি তখন হায় ,আর পিছে ফেরা যায় না বীথি।
তুই কি জানিস আমার বাবা এই লেখা পড়বেন না, বা যদি বাবা পড়েন ও তাহলে এত কাঁদবেন যে আমার মা আড়াল করে রাখবে আমার লেখা। আমার বাবা বেচে আছেন বীথি, যেমন আমার ছেলে বেচে আছে। একমাত্র ছেলেকে বোঝাতে পারছি না, আমার বেতনের একটা লিমিট আছে, আমার যোগ্যতার-ও লিমিট আছে, আমার বড় হবার সাথে সাথে সেই যোগ্যতার মাপকাঠি তৈরি হয়েছে। আমি খুব ভালো জানি , আমি করেছি তাই আমার জন্য এক জীবনে অনেক বেশী,এর চেয়ে বেশী দূরে যাবার যোগ্যতা আমি তৈরী করতে পারিনি।
গত চিঠিতে লেখছিলাম আমার বিপদের কথা বীথি, আমার গাড়ির ইন্সুরেন্স অনেক হাই হয়ে গেছে। এই মুহুর্তেই একটা পার্ট টাইম জব বা বাসা বদলে বেসমেন্ট এ চলে গেলে আমার জন্য খুব ভালো হয়। কিন্তু ছেলেটার মনটা ছোট হবে। নাইয়া বলছে , মা আমার এই ঘর অনেক ভালোবাসি আমি বেসমেন্ট এ যেতে চাই না। আমি এটাও বুঝি আমার বাস্তবতা এখুনি নাইয়ার বোঝার কথা না, জীবন আর কতটুকু বল ? নাইয়া আছে আমার সাথে আর মাত্র ৬/৭ বছর , তারপর বাকী জীবন হয়তো কষ্ট করার বা বোঝা বইবার সময় পাবো ,কিন্তু আজকে আমার ছেলের আনন্দের সময় বয়ে গেলে আর সময়টা ফিরে পাবো না বীথি ।
আমার বাবার কিন্তু এইটুকু চিন্তা করার অবকাশ ছিলো না, বিদেশ না থাকলে আমিও এটা ভাবতে পারতাম না । মনে আছে তোর? বড়পার বিয়েতে বাবাকে লোন করতে হয়েছিলো অনেক টাকা, তাই দেখে আমি আর কনা, খুব অল্পে আমাদের বিয়ে সেরেছিলাম। ভালো করেছিলাম কাজটা কারন আমার বাবা / মা আমাদের অহেতুক আদর না করে আমাদেরকে জীবনের জন্য তৈরি করে দিয়েছিলেন অনেক অনেক আগেই। সময়ের অনেক আগেই বাস্তব বুঝতে হয়েছিলো বীথি । সেটার সুবিধা আমার ভোগ করছি এই জীবনে। কিন্তু বেশী দায়িত্ব নেবার কিছু আসুবিধাও আছে। সেই আসুবিধার নাম হোলো বিবেক। মানুষ যখন নিজের কাছে মাথা উচু করে বাচতে চায় , নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকতে চায় তখন তার অপশন ক্রমেই কমে আসতে থাকে, তাই দেখেছি বাবাকে, বাবা আস্তে আস্তে চোখের সামনেই নির্মোহ হয়ে গিয়েছিলেন, কোন কিছুতেই ভালো মন্দ বলতেন না, ক্যামন একা হতে হতে সুদু বই আর সুন্যতা কে ভালোবেসে ফেলেছিলেন, আমি কি আস্তে আস্তে সেদিকে যাবো বীথি ? সুদু দোয়া করিস ,আমি যেনো সাহস আর বিস্বাশ হারিয়ে না ফেলি,জীবনকে যেনো বার বার চ্যালেঞ্জ করার সাহস থাকে আমার । আদর ।
১৩ /০৬/২০১৪
আরো পড়ুন: বীথির কাছে চিঠি-৩৫