Sat, Oct 14, 2017 10:25 AM
খুরশীদ শাম্মী : মঞ্চে শাঁওলী মিত্রের নাটক ‘নাথবতী অনাথবৎ” দেখবার সুযোগ হয়নি কখনো। তবে তার লেখা বই “নাথবতী অনাথবৎ” পড়বার সুযোগ হেয়েছে বন্ধুসেরীনের জন্য। এক বিকেলে সে বইটি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এটি একটি নাটকের বই। আশাকরি সময় করে বইটি পড়বে। তোমার ভালো লাগবে।“
এক অলস দুপুরে পুরাতন বইটির পাতা উল্টাতে উল্টাতে নিজের অজান্তেই মনের মধ্যে একটা ঘুণেধরা ধারনাকে স্থান দিয়ে বসলাম, মহাভারতের কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র দ্রৌপদীকে নিয়ে লেখা নাটক ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ -এই চার পুরুষার্থ ছাড়া আর কী ই বা হতে পারে!
এরপর বইটি পড়বার পালা। পড়তে শুরু করলে ধীরে ধীরে এমনভাবে মিশে যাই বইয়ের সাথে যেন বইয়ের পাতা থেকে আর দৃষ্টি সরতে চাচ্ছিলো না। যার শুরুটা শাঁওলী মিত্র তার নিজের কথা নাটকের মূল চরিত্র কথকের মাধ্যমে এভাবে শুরু করেছিলোঃ
“গড় হয়ে নমস্কার করি গো মশায়রা।– কাহিনী তো খুঁজে পাই না! কী যে বলি, কি যে বলি মশায়েরা! বলি, বলার কতা তো কত! কিন্তু কোনটা বলি, কেমনে বলি! এই কতা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হ’লো-
[সুর করে ছড়া কেটে]
মহাভারতের কথা অমৃত সমান
যুগে যুগে হয় তার নতুন ব্যাখ্যান,
হয় নতুন ব্যাখ্যান!
(হেসে) মনে বড় ধরলো! আর তাইতে মশায়েরা, মনে পড়ল এক রানীর কথা! রানী কিন্তু রানী নয়! সম্রাজ্ঞী কিন্তু সম্রাজ্ঞী নয়। রাজ্যেশ্বরী হয়েও রাজ্যহারা, সব পেয়েও সব্বেহারা এক অভাগিনী মেয়ের কথা। মশায়েরা –“
শাঁওলী মিত্র তার কলমের কালো কালিতে এমনভাবে রঙিন মঞ্চ ও নাথবতী দ্রৌপদীর জীবন চরিত্রে অনাথবৎ করুণ কাহিনীগুলোর প্রতিটি দৃশ্যের বর্ণনা করেছেন, পড়বার সময় মনে হলো আমি বই পড়ছি না; যেন দ্রৌপদীকেই দেখছি। ৬৭ পৃষ্ঠার বইটি পড়ে শেষ করি এক বসায়।
পড়া শেষে মনে হলো, মহাভারতের পাঞ্চালী – যজ্ঞসেনী- মহাভারতী- সৈরিন্ধ্রী – কৃষ্ণা - দ্রৌপদীকে নিয়ে লেখা নাটক এমনই তো হওয়ার কথা! তবুও পড়বার সময় মনে হয়েছিলো অর্জুন কেন এমন নিষ্ঠুর হলো? আবার দ্রৌপদী চরিত্রে ধাপে ধাপে বর্ণিত কষ্টগুলো তো সে সময়ের নারী জীবনের প্রতিচ্ছবি মাত্র। অবশ্য এমন অভাগা নারী এখনও যেমন আছে আমাদের সমাজে, ঠিক তেমনি অর্জুনেরা বেঁচে আছে বংশপরম্পরায়। তারা হয় সদা জাগ্রত নয় থাকে সুযোগের অপেক্ষায়।
তবে সকল অবেহেলা, লাঞ্চনা, বঞ্চনার মাঝেও প্রতিটি জীবনে থাকে কিছু এক পক্ষীয় ভালোবাসা যা হয়তো মনে ধরে না, দেখা যায় না। যেমন, শাঁওলী মিত্রের কথকের বর্ণনায়,
“আচ্ছা, ভালোবাসা কি সবসময়ে এইরকমই? এক পক্ষের? আমি একজনকে ভালোবেসে বেসে মরি, সে আমাকে ফিরেও দেখে না। আবার আর কেউ হয়তো, আমাকে-“
ঠিক তেমনি দ্রৌপদীর জীবনেও ছিলো একজন। কথক যেভাবে বর্ণনা করেছিলঃ
“হ্যাঁ, ছিলো তো একজন!- ভীম! হ্যাঁ ভীম! স্বয়ম্বর সভার যুদ্ধের সময়ে ভীম এসে দাঁড়িয়েছিলো অর্জুনের পাশে। সেই বীভৎস পাশাখেলার দিনে ভীম চেয়েছিলো তার জ্যেষ্ঠের হাত দুটো পুড়িয়ে দিতে। ভীম চেয়েছিলো দুর্যোধন আর দুঃশাসনকে তৎক্ষনাৎ নাশ করতে। পরে সেই তা করেছিলো। যে ঊরু দেখিয়ে দুর্যোধন তাকে অপমান করেছিলো, অন্যায় যুদ্ধে হলেও দুর্যোধনের ঊরু ভেঙে দিয়েছিলো ভীম! যে দুঃশাসন তাকে নগ্ন করার চেষ্টা করেছিলো, তার বুক চিরে রক্তপান করেছে ভীম!
[হঠাৎ এক সুখস্মৃতি মনে আসে]
ভীম কত ঝুঁকি নিয়ে তাকে স্বর্ণপদ্ম তুলে এনে দিয়েছিলো ।
[সেই স্বপ্ন ভেঙে আবার মনে পড়ে]
হ্যাঁ, সেই বনবাসেও তো, – জটাসুরকে শাস্তি দিয়েছিলো ভীম, জয়দ্রথকে শাস্তি দিয়েছিলো ভীম। কীচককেও মেরেছিলো ভীম। সে অত ‘ধর্ম’ ‘ধর্ম’ করেনি। যে অর্থে দ্রৌপদী এই মাটির মেয়ে সেই অর্থে ভীম-ও এই মাটির সন্তান। সেখানে সে মিলতে পারে একমাত্র ভীমের সঙ্গেই। ভীম কতবার তার কষ্টের মধ্যে এসে তাকে জিজ্ঞাসা করেছে,
-‘তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে, পাঞ্চালী?’ ”
সমাপ্তিটা বেদনাদায়ক হলেও দ্রৌপদী যে ভীমের ভালবাসা বুঝতে পেরে পরবর্তী জীবনে তার সঙ্গী হতে চেয়েছে, সেটা ভালোলেগেছে। অন্তত মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত হলেও সে যে ভীমের ভালোবাসাটা বুঝতে পেরেছে।
সবশেষে বলতে হয়, এটি একটি ভালো পাঠ ছিলো অবশ্যই। নামকরণও হয়েছে যথার্থ। পাঁচজন স্বামীর সধবা স্ত্রী হয়েও যে দ্রৌপদীর জীবনটা যখন ছিলো অনাথ সদৃশ তাকে “নাথবতী অনাথবৎ” ছাড়া শাঁওলী মিত্র আর কী ই বা আখ্যা দিতে পারত?
১১ অক্টোবর, ২০১৭,টরন্টো, অন্টারিও