Wed, Dec 9, 2020 8:21 AM
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: বাংলাদেশ ব্যাংক-এ কর্মরত আমার এক প্রাক্তন ছাত্র এই ছবিটি তুলে আমাকে পাঠিয়ে বলেছে রিপোর্টটি ব্যাংকের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে এবং সে এটি পড়ে খুব উপকৃত হয়েছে, কারণ তার মতে ব্যাংক খাত সংস্কারের সব নির্দেশনাই এতে আছে।
তবে আমার মতে এই রিপোর্টের কিছু বিষয় যুগোপযোগী করা দরকার। যেমন বাজার অর্থনীতিতে শেয়ার কিনে একটি ব্যাংকের মালিকানা দখল করার সুযোগ থাকে, কিন্তু এ সুযোগের অপব্যবহার করে এ খাতে একচেটিয়া দখলদারি তৈরী হওয়া যে বিপজ্জনক এবং তার প্রতিকারের কিছু নিয়মনীতি থাকা যে দরকার তা এই রিপোর্টে নাই। অলাভজনক খেলাপি প্রতিষ্ঠান বন্ধের জন্য দেউলিয়া আইনের সুযোগ দেয়ার ব্যাপারেও তেমনটা বলা হয় নাই। বড় অঙ্কের জালিয়াতি ও বিদেশে পাচারের অর্থ ব্যাঙ্কিং খাতের মধ্য দিয়ে কি করে হাত বদল হয় তা পর্যবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের মানি লনডারিং প্রতিরোধ কার্যক্রমের বিষয়ও তখন আলোচনায় আসে নি। তার চেয়ে বড় কথা হলো এত আয়োজন ও পরিশ্রম করে তৈরী সংস্কারের রিপোর্ট তো লাইব্রেরীতে সেলফবন্দি হয়ে থেকে লাভ নেই যদি বাস্তবায়ন না হয়।
এই রিপোর্টের বেশ কিছু সুপারিশ এক সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা প্রবিধি হিসাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছিলো, কিন্তু পরবর্তিতে ব্যাঙ্কিং আইনে রূপান্তরিত করা হয় নি বলে সেগুলো আর কার্যকর থাকে নি। বরং ব্যাঙ্কিং আইনে বিধিনিষেধগুলো আরো শিথিল করার ফলে অনিয়মের সুযোগ আরো বেড়ে গেছে।
মনে আছে নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে এই সংস্কার কমিটির কাজ শুরু করার সময় ব্যাংক মালিকদের সংঘটনের মিটিংয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনারা তো ব্যাক্তিখাতে ব্যাঙ্কিং ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করেছেন মুনাফা পেতে, ব্যাঙ্ক ভালো চললে তো আপনাদেরই লাভ। উত্তরে সংঘটনের সভাপতি যা বল্লেন তার সারাংশ দাঁড়ায়: বোকার ভান করবেন না, মূলধন ছাড়াও অনেক বাড়তি খরচ করে ব্যাংক দিয়েছি; এখন নিজেদের জন্য সেই ব্যাংকের আমানতের অন্ততঃ কিছু অংশ নিয়ে নেব না তা কি হয়? সে সময় বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মোট আমানতের তিন ভাগের এক ভাগই ছিল উদ্যোক্তা-পরিচালকদের নেয়া ঋণ, যার অধিকাংশই ছিল খেলাপি।
পরবর্তিতে ব্যাংক সংস্কারের জন্য গৃহীত পদক্ষেপ ও উচ্চ আদালতের সক্রিয়তার কারণে অন্ততঃ ৫৪ জন উদ্যোক্তা-পরিচালককে অপসারণ করা হয় নিজেদের ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণ খেলাপি হবার কারণে, এছাড়া আরও ৭৩ জন তাঁদের নেয়া ঋণ নিয়মিত করতে বাধ্য হন, আর ৮ জন তখন আদালতের স্থগিতাদেশ নিতে সক্ষম হন। এর পর থেকে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের এ ধরনের ঋণ নেয়ার সংস্কৃতির অবসান হয়; দেখা গেলো যে আইনত যে পরিমাণ ঋণ তাঁরা নিতে পারেন, তাও নিচ্ছেন না।
ইদানীং কালে ব্যাঙ্কিং খাতে নিয়ম নীতি শিথিল করার ফলে আরও মারাত্মক ধরণের অনিয়ম-দূর্নীতির সুযোগ তৈরী হয়েছে। অবস্থা দেখে মনে হয় এক সময় কিছুদূর অগ্রসর হয়ে আমারা যেনো আবার পেছনের দিকে হাঁটছি।
লেখক: ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, অর্থনীতিবিদ
লেখাটি লেখকের ফেসবুক থেকে নেয়া