Mon, Jul 9, 2018 12:47 AM
খালিদ খলিল: কোন মানুষ যখন তাঁর কোন কাজের মাধ্যমে সব শ্রেণীর মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পারেন অথবা তাঁর দ্বারা মানবজাতির কোন কল্যাণ সাধিত হয়, তখনই তিনি কিংবদন্তি'তে পরিণত হন। আজ এমন দু'জন কিংবদন্তির গল্প বলবো।
একজন চিত্রশিল্পী, শিল্প-সংস্কৃতির পুরোধা কামাল আহমেদ, আরেকজন সঙ্গীতের মানুষ- গিটার শিল্পী, স্বরলিপিকার, সুরকার এনামুল কবির। গত সোমবার তাঁরা মুখোমুখি হন টরেন্টো'ত। আমি সুযোগ পাই তাঁদের আলাপচারিতার মধ্যে যোগ দেবার। ভিডিও কনফারেন্সে যোগ দিই। সাথে ছিলেন প্রবাসী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী নাহিদ কবির কাকলি। মূলত তিনিই আমাকে সুযোগ করে দেন এই কিংবদন্তি শিল্পীদ্বয়ের সাথে আলাপচারিতার।
প্রবাসে থাকায় কিনা অথবা আমাদের হীনমন্যতায় হোক- আজ আমরা কামাল আহমেদকে ভুলতে বসেছি। সাতাশি বছর বয়সে এসে আজ তাঁর শুধু আক্ষেপ। তিনি করুণা চান না, তিনি স্বীকৃতি চান। আজ বাংলাদেশ ফিফা'র সদস্য- এই সদস্য পদও এসেছিল বঙ্গবন্ধু'র দিক-নির্দেশনায়, কামাল আহমেদ এর অক্লান্ত পরিশ্রমের কল্যাণে। বঙ্গবন্ধু তাঁকে একান্তে ডেকে বলেছিলেন, 'কামাল আমরা ফিফা'র সদস্যপদ চাই। তুই পতাকা থেকে শুরু করে যাবতীয় দায়িত্ব নিয়ে প্রক্রিয়া শুরু কর। মনে রাখবি যেনো অন্য দেশের সাথে মিলে না যায়'। কামাল আহমেদ বলছিলেন, 'আমি বঙ্গবন্ধু'র নির্দেশ পেয়ে কাজ শুরু করি এবং পতাকা থেকে শুরু করে মোজার রঙ, ডিজাইন সহ সকল কাজ সম্পন্ন করে সাবমিট করি। আল্লাহ'র অশেষ মেহেরবাণীতে প্রথমবারেই আমরা সদস্যপদ লাভ করি'। কামাল আহমেদ স্বাধীনতা পূর্ব থাকতেন কোলকাতা পার্ক সার্কাসে। সেখানে শিল্প-সংস্কৃতির মানুষদের যাতায়াত ছিলো। যেতেন কিংবদন্তি গিটার শিল্পী সুনীল গাঙ্গুলী, কাজী অনিরুদ্ধ। কামাল আহমেদ এর বাড়ি ছিলো তাঁদের কাছে ভালোলাগার জায়গা। সুনীল গাঙ্গুলী ছিলেন 'কম্প্রোমাজার শিল্পী'- তিনি সুরের সাথে আপোস করতে পারতেন আর কাজী অনিরুদ্ধ ছিলেন 'গ্রামাটিক্যাল শিল্পী'- তিনি ব্যাকরণের বাইরে যেতেন না- এমনই মূল্যায়ন ছিলো এই দুই শিল্পী সম্পর্কে।
কামাল আহমেদ অনুযোগের সুরে জানালেন, 'তাঁর জীবদ্দশায় তাঁকে ইতিহাস বিকৃতি দেখতে হচ্ছে। এর মীমাংসা জরুরী। কালের স্বাক্ষ আমরা যখন থাকব না তখন কী হবে? এর মধ্যে মারা গেছেন স্বাধীন বাংলা বেতারের বেলাল মোহাম্মদ। জাতি বিস্মৃত হননি এখনো- স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন বেশ কিছু গান জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল স্বাধীনতা অর্জনে। এসব গানের শীর্ষ গীতিকার ছিলেন গোবিন্দ হালদার। আমিই তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে স্বাধীন বাংলা বেতারের জন্য গান লিখতে। তিনি লিখেছিলেন, 'এক সাগর রক্তের বিনিময়ে', 'মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি', 'পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে' ইত্যাদি। এমন সব গান গোবিন্দ হালদারকে সাথে নিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতারের বেলাল মোহাম্মদ এর হাতে তুলে দিয়েছিলাম আমি কামাল আহমেদ।' এমন অনেক ইতিহাসের স্বাক্ষী, ইতিহাসের কালজয়ী কাজের কাজী কামাল আহমেদ।
কামাল আহমেদ এর সাথে গিটার কিংবদন্তি এনামুল কবির এর সম্পর্ক মামা-ভাগ্নে। এনামুল কবির এর স্বরলিপি বিষয়ক অনেক বইয়ের প্রচ্ছদ শিল্পী কামাল আহমেদ। কামাল আহমেদ এর হাত ধরেই গোবিন্দ হালদারের সাথে পরিচয় এনামুল কবির এর। তাও ত্রিশ বছর- গোবিন্দ হালদারের প্রায় সব গানের স্বরলিপি তিনি করেছেন, গিটার সুরে অ্যালবাম করেছেন। গোবিন্দ হালদারের সাথে আমৃত্যু সখ্যতা ছিলো এনামুল কবির এর নিবিড়। প্রায় চিঠি লিখতেন এনামুল কবির এর কাছে। সেসব চিঠি আজ ইতিহাসের স্বাক্ষী। মুক্তিযুদ্ধের কথা, দু' দেশের গানের কথা- সব উঠে আসতো এসব চিঠিতে। অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে গোবিন্দ হালদার-এনামুল কবির এর মধ্যে আদান-প্রদানকৃত চিঠির খোঁজে, তাঁর গানের স্বরলিপির খোঁজে দ্বারস্থ হন এনামুল কবির এর।
একজন সাতাশি, আরেকজন সাতাত্তর- এতো লম্বা জীবনের কথকতা কী আর এক ঘন্টায় শেষ হয়। জাতীয় জীবনে কতই না তাঁদের অবদান। সেসব থেকো গেলো বাকী। যেমন বাকী পড়ে রয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। তাঁদের জীবদ্দশায় আদৌ তা পূরণ হবে কী? যদি না হয়- প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এ ঋণের ভার বইতে হবে।
লেখকের ফেসবুক পোষ্ট থেকে